দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন ইউরোপীয় উপনিবেশে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি সাম্রাজ্যগুলো বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিজেদের গুঁটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
১৯৪৫ থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অধিকাংশ ঔপনিবেশিক অঞ্চল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু, দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসকদের লুটতরাজে নিঃস্ব সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর উন্নয়ন নানাবিধ আর্থসামাজিক পরিস্থিতে থমকে ছিল।
ইতোপূর্বে অ্যাডাম স্মিথ, স্যার উইলিয়াম পেটি, কার্ল মার্ক্স প্রমুখ অর্থনীতিবিদের তত্ত্ব-মতবাদ বহুল পরিচিত ও প্রযোজ্য হলেও এসময় সেগুলোর বিকল্প ও সময়োপযোগী ধারণা-তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ‘তৃতীয় বিশ্বের দেশ’ বা ‘অনুন্নত দেশ’ হিসেবে পরিচিত পাওয়া এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে পাশ্চাত্যে প্রচুর গবেষণা শুরু হয়।
যার পরিণতিতে ‘উন্নয়ন অর্থনীতি’ নামে অর্থনীতির একটি স্বতন্ত্র শাখার উদ্ভব ঘটে। গবেষকগণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন অনেক ধারণা ও তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তেমনি একটি উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব হচ্ছে মার্কিন অর্থনীতিবিদ ওয়াল্ট রস্টো-র ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্তর’ তত্ত্ব। ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তর’, ‘উন্নয়নের স্তর তত্ত্ব’, ‘Stages of Economic Growth’, ‘Rostovian Take-Off Model’ ইত্যাদি নামেও তত্ত্বটি পরিচিত।
তাত্ত্বিক ও তত্ত্বের পটভূমি – Background of Theory & Theorist
ওয়াল্ট হোয়াইটম্যান রস্টো (Walt Whitman Rostow, ১৯১৬ – ২০০৩) একাধারে অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা এবং বক্তৃতা লেখক সহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
ষাটের দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি-বিষয়ক সকল নীতি প্রণয়নে ওয়াল্ট রস্টো মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। এসময় এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকায় কমিউনিজমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে রস্টো পুঁজিবাদ এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতি সম্পর্কে একাধিক গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও তত্ত্ব প্রকাশ করেন।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত রস্টোর সর্বাধিক আলোচিত গ্রন্থ “The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto”-এ ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তর’ তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো যখন রুশ সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল, তখন অর্থনৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে সেই রাষ্ট্রগুলোকে পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনা থেকেই রস্টোর এই তত্ত্ব প্রদান করেন।
এই তত্ত্বে প্রভাবিত জন এফ. কেনেডি রস্টোকে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। কেনেডির জনপ্রিয় “New Frontier” বক্তৃতাও তিনি লিখেছিলেন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনতও রস্টোকে তাঁর উপদেষ্টা এবং বক্তৃতা লেখকের পদে নিয়োজিত করেন। উভয় প্রেসিডেন্টের আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন ও কর্মকাণ্ডে রস্টো এবং তার ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্তর’ তত্ত্ব প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তর’ তত্ত্ব – ‘Stages of Economic Growth’ Theory
ব্রিটেন তথা যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড এবং ওয়েলসের শিল্প-বিপ্লব এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কেস স্টাডি হিসেবে বিশ্লেষণ করেই মূলত ওয়াল্ট রস্টো ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তর’ তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। কার্ল মার্ক্সের সমাজতন্ত্র ভিত্তিক ‘শ্রেণি সংগ্রাম’ তত্ত্বের পুঁজিবাদ বা মূলধন নির্ভর বিকল্প প্রদানেই রস্টো এই তত্ত্ব দিয়েছিলেন। 1গ্রন্থ: America’s Rasputin: Walt Rostow and the Vietnam War; লেখক: David Milne; প্রকাশকাল: ২০০৮; প্রকাশক: Hill and Wang, New York;
রস্টো-র মতে, একটি রাষ্ট্র বা সমাজকে আদিম বা অনুন্নত স্তর থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা উন্নতির স্তরে পৌঁছাতে পাঁচটি স্তরের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।2গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press; নিন্মে এই পাঁচটি স্তর এবং তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো –
সনাতন সমাজ – Traditional Society
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক স্তর সনাতন সমাজ কৃষি-নির্ভর হয়, যদিও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় উৎপাদন সীমিত এবং অপ্রতুল হয়ে থাকে। উৎপাদনের জন্য আবাদি জমি এবং সমাজের সার্বিক ক্ষমতা স্বল্প কিছু ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকায় সমাজে শ্রেণিবিভক্তি দেখা দেয়। ফলে সেই সমাজের লক্ষণীয় পরিবর্তন এবং উন্নয়ন হয় না।
রস্টো-র ভাষায়, “সনাতন সমাজ হল এমন একটি সমাজ, যার কাঠামো প্রাক-নিউটনিয়ান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বাস্তব জগতের প্রতি প্রাক-নিউটনিয়ান মনোভাবের উপর ভিত্তি করে সীমিত উৎপাদন কর্মকাণ্ডের মধ্যেই আবর্তিত হয়।”3উদ্ধৃতি: “A traditional society is one whose structure is developed within limited production functions, based on pre-Newtonian science and technology and on pre-Newtonian attitude towards the physical world.”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইন্সের ভাষ্যমতে, “খ্রিস্টের জন্মের দু’হাজার বছর আগে থেকে আঠারো শতকের শুরু পর্যন্ত পৃথিবীর সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের কোনো বড় পরিবর্তন হয়নি। উঠানামা হয়েছে নিশ্চয়ই। দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধও দেখা দিয়েছে। কখনও এসেছে সোনালি বিরতি। কিন্তু প্রগতিশীল কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।”4গ্রন্থ: পরার্থপরতার অর্থনীতি; লেখক: আকবর আলী খান; প্রকাশকাল: ২০১০; প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা; অর্থনৈতিকভাবে স্থবির সেই যুগকেই রস্টো রূপকার্থে ‘প্রাক-নিউটনিয়ান’ বা বিজ্ঞানী নিউটনের পূর্বযুগ বলেছেন।
রস্টো সনাতন সমাজের সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে –
- কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি;
- অনুন্নত প্রযুক্তি;
- সম্ভাবনা সত্ত্বেও সীমিত উৎপাদনশীলতা;
- শিল্পের স্বল্পতা ও উৎপাদনে সীমাবদ্ধতা;
- শ্রেণীবিভক্ত সমাজ ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা;
- জমির মালিকদের অসীম প্রভাব;
- যুদ্ধ ও মহামারীর কারণে জীবনের অনিশ্চয়তা;
এই স্তরে সমাজের অধিকাংশ শ্রমশক্তি কেবল খাদ্য উৎপাদনেই নিয়োজিত থাকে। উন্নত প্রযুক্তি এবং শিল্পের অভাবে পর্যাপ্ত উৎপাদন হয় না। ফলে সমাজে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে না এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে বর্ধিত উৎপাদন সম্ভব হয় না। বরং, ভূমি-মালিকদের বিলাসিতা, যুদ্ধ, মহামারি ইত্যাদি প্রায়ই সেই সীমিত উৎপাদনকেও ব্যাহত করে।
উড্ডয়নের পূর্বাবস্থা – Preconditions For Take-Off
উড্ডয়নের পূর্বাবস্থার স্তরে বিক্ষিপ্ত সমাজগুলো মিলে জাতি-রাষ্ট্র গঠন করে এবং কল্যাণমূলক শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠে। এই স্তরে সমাজগুলো অসংখ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। প্রথাগত সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের চেয়ে ভিন্নধর্মী কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে এসময় সমাজের সদস্যরা নানান দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে।
পরবর্তীতে, উদ্যোগী ব্যক্তিরা এগিয়ে আসে ঝুঁকি নিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় কৃষির পাশাপাশি শিক্ষা, যোগাযোগ, বাণিজ্যেও পুঁজির বিনিয়োগ ঘটে এবং এসব খাত উন্নত হয়। ফলে উৎপাদন এবং বাজার সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। ফলে, রাষ্ট্রের জাতীয় আয় ৫%-র মত বৃদ্ধি পায়।
রস্টো-র ভাষায়, “প্রবৃদ্ধির দ্বিতীয় স্তরে সমাজগুলো পরিবর্তনকে মেনে নেয়; এসময় উড্ডয়নের পূর্বাবস্থা বা পরিস্থিতিগুলো সৃষ্টি হয়; কারণ একটি সনাতন সমাজকে আধুনিক বিজ্ঞানের ফল ভোগ করতে, ক্রমহ্রাসমান উৎপাদনকে স্থিতিশীল করতে এবং এভাবে চক্রবৃদ্ধি মুনাফার অগ্রযাত্রার মাধ্যমে উন্মোচিত আশীর্বাদ এবং আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবায়নে যথাযথ উপায়ে রূপান্তর করতে সময় লাগে।”5উদ্ধৃতি: “The second stage of growth embraces societies in the process of transition; that is, the period when the preconditions for the take-off are developed; for it takes times to transform a traditional society in the ways necessary for it to exploit the fruits of modern science, to fend off diminishing returns, and thus to enjoy blessings and choices opened up by the march of compound interest”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
তার মতে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে এই স্তর প্রথম পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের প্রভাবে সেখানকার কৃষি এবং শিল্পের উৎপাদন গতিশীলতা পায়, যা পরবর্তীতে বিশ্ব বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
সনাতন সমাজ থেকে উড্ডয়নের পূর্বাবস্থার স্তরে পৌঁছাতে নিন্মক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো প্রভাবক হিসেবে কাজ করে –
- আধুনিক অর্থনৈতিক ও উৎপাদনমুখী শিক্ষা;
- শিল্প সৃষ্টি এবং সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগ;
- উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার ও ব্যবহার;
- শিল্পের বিকাশ ও বাণিজ্যের প্রসার;
এসব বৈশিষ্ট্য সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় স্থিতিশীলতা আনে। ফলে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয় এবং স্বাভাবিক উৎপাদনের সঙ্গে নিত্য-নতুন উৎপাদন কার্যক্রমের মাধ্যমে শিল্পায়ন ঘটে। উদ্বৃত্ত উৎপাদন আমদানির মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে।
উড্ডয়ন – Take-Off
উড্ডয়ন রস্টোর তত্ত্বের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়। এই স্তরের প্রারম্ভে রাজনৈতিক বিপ্লব, প্রযুক্তিগত বিপ্লব, কিংবা অনুকূল আন্তর্জাতিক পরিবেের কারণে জনমনে বিপুল উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। এসময় শিল্পায়ন এবং নগরায়ন অতি দ্রুত সম্প্রসারিত হয়।
উড্ডয়নকালে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় এবং কর্মীরা সঞ্চয়ে অভ্যস্ত হয়। পরবর্তীতে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তারা উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করে এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশলকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠে।
ফলে, উন্নয়ন সমাজ বা রাষ্ট্রের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে পরিগণিত হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোতে বিনিয়োগ এবং তা থেকে মুনাফা অর্জনের ধারণা সুগঠিত হয় এবং কালক্রমে তা অভ্যাসে পরিণত হয়।
রস্টো-র ভাষায়, উড্ডয়নকালে “উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাত্রা একটি জটিল পর্যায়ে পৌঁছায় এবং পরিবর্তন সৃষ্টি হয়, যা অর্থনীতি এবং সেই সমাজের একটি ব্যাপক ও প্রগতিশীল কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটায়, এই পরিবর্তনকে মাত্রার চেয়ে ধরণ দিয়ে বিবেচনা করা শ্রেয়।”6উদ্ধৃতি: “…the scale of productive economic activity reaches a critical level and produces changes which lead to a massive and progressive structural transformation in economies and the societies of which they are a part, better viewed as changes in kind than merely in degree.”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
তার মতে, উড্ডয়নের জন্য তিনটি বৈশিষ্ট্য বা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিরাজমান থাকা আবশ্যক। সেগুলো হচ্ছে –
- উৎপাদনমুখী বিনিয়োগের হার জাতীয় আয় অথবা নিট জাতীয় উৎপাদনের ৫% (অথবা তার কম) থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে হবে;
- এক বা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হার অর্জন করতে হবে;
- একটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও কাঠামোগত রূপরেখা থাকতে হবে, যা আধুনিক খাত ও সম্ভাব্য বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণে সাহায্য করবে এবং উড্ডয়নকে স্থায়িত্ব প্ৰদান করবে;
এই স্তরে আধুনিকায়ন সূচিত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো উৎপাদনমুখী বিনিয়োগের জন্য পুঁজি ও সম্পদ সংগ্রহের লক্ষ্যে করারোপ, সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারে কিংবা ব্যাংক, অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান বা পুঁজিবাজার থেকে সহায়তা নেয়। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগ ও সহায়তা গ্রহণ অথবা ঋণ নিয়ে উৎপাদনমুখী শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারে।
এক্ষেত্রে, কৃষি, বস্ত্র, যোগাযোগ, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি প্রধান উৎপাদনমুখী শিল্পের ভূমিকা রাখে। এসব শিল্পের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সহায়ক বা উদ্ভূত খাত (Derived Growth Sector) গড়ে উঠে।
পরিপূর্ণতা লাভের প্রচেষ্টা – Drive to Maturity
উড্ডয়ন স্তরে সাফল্য অর্জনের পর একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার সক্ষমতা লাভ করে। অর্থাৎ, দেশটির শিল্প এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিপক্ব হয়ে উঠে।
এই স্তরে রাষ্ট্র বা সমাজের সম্পদের প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকরিভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। শিল্পায়ন প্রক্রিয়া বহুমুখী হবে, নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে গতি সঞ্চারিত হবে এবং পূর্বের প্রধান শিল্পগুলোর জায়গায় নতুন শিল্পগুলো স্থান করে নিবে। শহরের সুযোগ ও সীমানা মফস্বল পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
রস্টো-র ভাষায়, “উড্ডয়নের পর প্রবৃদ্ধি ওঠানামা করলে (শিল্পের) স্থায়িত্ব বা পরিপূর্ণতা পেতে একটি দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে, কেননা এসময় নিয়মিতই উদীয়মান অর্থনীতি তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সর্বক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করে।”7উদ্ধৃতি: “After take-off there follows a long interval of sustained if fluctuating progress, as the now regularly growing economy drives to extend modern technology over the whole front of its economic activity.”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
উড্ডয়ন স্তর থেকে পরিপক্বতা লাভের প্রচেষ্টার স্তরে পৌঁছাতে রস্টো নিন্মক্ত শর্তাবলী উল্লেখ করেছেন –
- অর্থনৈতিক বিনিয়োগের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে ১০% থেকে ২০% পর্যন্ত হবে;
- আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় গুটিকয়েক শিল্পের পরিবর্তে নতুন এবং বৈচিত্র্যময় শিল্পের বিকাশ ঘটবে;
- আমদানির পরিবর্তে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং রপ্তানি খাতের পণ্য ও বাজার সম্প্রসারিত হবে;
একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিপূর্ণতা বা পরিপক্বতা লাভের জন্য উড্ডয়ন পরবর্তী পর্যায়ে প্রায় ৬০ বছর সময় লাগতে পারে। এসময় জাতীয় আয়ের ১০ থেকে ২০% ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগকৃত হবে, যার ফলে প্রবৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যাবে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্থায়িত্ব নিশ্চিত হবে।
উচ্চ গণভোগের কাল – Age of High Mass-Consumption
অর্থনৈতিক পরিপক্বতা লাভের মাধ্যমে, রস্টো-র মতে, একটি রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্রে (Welfare State) পরিণত হয়। এই স্তরে জনমনে ভোগ্যপণ্য ব্যবহার, সামাজিক নিরাপত্তা, বিনোদন ও অবকাশ যাপনের মানসিকতা তৈরি হয়। অর্থাৎ, পরিপক্বতা লাভের পর উচ্চ ভোগ-প্রবণতা সৃষ্টি হবে। তবে, অর্থনীতি থমকে না গিয়ে বরং ক্রমাগতভাবে চলতে থাকবে।
পরিপক্কতা লাভের প্রচেষ্টা থেকে উচ্চ গণভোগ প্রবণতার স্তর পর্যন্ত বিকাশের পর্যায়টি সব থেকে দীর্ঘতম স্তর। এসময় প্রধান বা নেতৃস্থানীয় শিল্প খাতের ভূমিকা পালন করে টেকসই ভোগ্য পণ্যের শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠান।
রস্টো-র মতে, এসময় অর্থনীতিতে নিন্মলিখিত পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে –
- রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিকের আয় বৃদ্ধি পেয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যাতে তারা মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য ভোগ্য পণ্য এবং সেবা খাতে ব্যয় করতে পারে;
- শিল্পের কাঠামোগত এবং শ্রমশক্তির গুণগত পরিবর্তন আসে, নগরকেন্দ্রিক শিল্প গড়ে ওঠে এবং দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়;
- রাষ্ট্র বা সমাজগুলো নাগরিকদের কল্যাণ এবং সামাজিক নিরাপত্তার দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করে;
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ ভোগ-প্রবণতা স্তরে পৌঁছায় ১৯২০ সালে, জাপান এবং পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ১৯৫০-র দশকের মধ্যে এই স্তরে পৌঁছায়। রস্টো-র মতে, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া)-র আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিও এই স্তরে পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত ছিল এবং সেখানকার নাগরিকরাও তা চেয়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট শাসনের কারণে সেসময় তা হয়ে ওঠেনি।8উদ্ধৃতি: “The Soviet Union is technically ready for this stage, and, by every sign, its citizens hunger for it; but Communist leaders face difficult political and social problems of adjustment if this stage is launched.”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
তত্ত্বের সমালোচনা – Criticism of Theory
রস্টোর ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্তর’ তত্ত্ব বিভিন্ন কারণে বেশ সমালোচিত হয়েছে। বিশেষত, অনুন্নত দেশগুলোকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে মডেলটি প্রদান করা হলেও মডেলটি তৈরি হয়েছে তুলনামূলক উন্নত দেশগুলোকে গবেষণার নিরিখে।
যেমনঃ ব্রিটেন সহ ইউরোপের উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো উপনিবেশের সম্পদ দখলের মাধ্যমে শিল্পায়ন বা উড্ডয়নের পূর্বাবস্থার আগে থেকেই সমৃদ্ধশালী ছিল। তাই উড্ডয়নের জন্য তাদের বিনিয়োগ বা উৎপাদন নিয়ে বেগ পেতে হয়নি।
অপরদিকে, উপনিবেশগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও তাদের বিনিয়োগ বা উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বা পরিস্থিতি ছিল না। একারণে অনেকে রস্তোর তত্ত্বকে ‘উন্নয়ন অর্থনীতি’-র অন্তর্ভুক্ত মানতে নারাজ।
তাছাড়া, চীন, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলো বিশেষ কোনো শিল্পের উপর নির্ভর না করেই উড্ডয়ন এবং পরিপূর্ণতা লাভের স্তরে পৌঁছে গেছে। সেসব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটে না।
এই তত্ত্বের আরেকটি সমালোচনা হল, যেসব দেশকে নমুনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো আয়তন এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় তুলনামূলক বড়। তাদের পক্ষে পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ অর্জন সহজ। পক্ষান্তরে, আয়তনে ছোট কিংবা আফ্রিকার মরু অঞ্চল এবং কম জনসংখ্যার দেশগুলোর পক্ষে বড় দেশগুলোর মত একই গতিতে উন্নয়ন সম্ভব নয়।
প্রকৃতপক্ষে মার্কসীয় তত্ত্বের বিকল্প হিসেবে রস্টো তার স্তর তত্ত্ব প্রদান করেছেন বলে মনে করা হয়। উভয় তত্ত্বেই আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের পথ পরিক্রমা গুরুত্ব পেয়েছে। স্তর তত্ত্ব পুঁজিবাদী মতবাদের ধারক হলেও রস্টো “মার্ক্সের স্তরসমূহের যৌক্তিকতা, অনিবার্যতা বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজের তত্ত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনোরূপ সংস্কার প্রয়াসী হননি।”9গবেষণাপত্র: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশ: রস্টোর স্তর তত্ত্বের নিরিখে একটি পর্যালোচনা; লেখক: জি এম সোহরাওয়ার্দী; প্রকাশক: বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা; সংস্করন: খ ৩০ বার্ষিক সংখ্যা, ১৪১৯ বঙ্গাব্দ;
তথ্যসূত্র - References
- 1গ্রন্থ: America’s Rasputin: Walt Rostow and the Vietnam War; লেখক: David Milne; প্রকাশকাল: ২০০৮; প্রকাশক: Hill and Wang, New York;
- 2গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
- 3উদ্ধৃতি: “A traditional society is one whose structure is developed within limited production functions, based on pre-Newtonian science and technology and on pre-Newtonian attitude towards the physical world.”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
- 4গ্রন্থ: পরার্থপরতার অর্থনীতি; লেখক: আকবর আলী খান; প্রকাশকাল: ২০১০; প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা;
- 5উদ্ধৃতি: “The second stage of growth embraces societies in the process of transition; that is, the period when the preconditions for the take-off are developed; for it takes times to transform a traditional society in the ways necessary for it to exploit the fruits of modern science, to fend off diminishing returns, and thus to enjoy blessings and choices opened up by the march of compound interest”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
- 6উদ্ধৃতি: “…the scale of productive economic activity reaches a critical level and produces changes which lead to a massive and progressive structural transformation in economies and the societies of which they are a part, better viewed as changes in kind than merely in degree.”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
- 7উদ্ধৃতি: “After take-off there follows a long interval of sustained if fluctuating progress, as the now regularly growing economy drives to extend modern technology over the whole front of its economic activity.”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
- 8উদ্ধৃতি: “The Soviet Union is technically ready for this stage, and, by every sign, its citizens hunger for it; but Communist leaders face difficult political and social problems of adjustment if this stage is launched.”; গ্রন্থ: The Stages of Economic Growth: A Non-Communist Manifesto; লেখক: Walt Whitman Rostow; প্রকাশকাল: ১৯৬০; প্রকাশক: Cambridge University Press;
- 9গবেষণাপত্র: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশ: রস্টোর স্তর তত্ত্বের নিরিখে একটি পর্যালোচনা; লেখক: জি এম সোহরাওয়ার্দী; প্রকাশক: বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা; সংস্করন: খ ৩০ বার্ষিক সংখ্যা, ১৪১৯ বঙ্গাব্দ;