বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কিছু গণমাধ্যমে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য আলাদা বিভাগ চালু করা হয়। এই বিভাগের কাজ ছিল সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের সংবাদগুলো প্রকাশের আগে ও পরে যাচাই করে দেখা।
সেসময় ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকায় তথ্যের প্রবাহ এখনকার মত এত বিস্তৃত ও মসৃণ ছিল না। ফলে, সংবাদের যথার্থতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিতকরণেই মূলত গণমাধ্যমগুলো অভ্যন্তরীণভাবে ফ্যাক্ট চেকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতো।
তখন গণমাধ্যমগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল তথ্য বা ভুয়া সংবাদ প্রচার না করলে জনসাধারণের মাঝে ব্যাপকভাবে কোনো গুজব বা ভুল তথ্য ছড়াতো না। মুখে মুখে কিছু ছড়ালেও তার পরিসর ছিল সীমিত।
গত শতকের শেষে ইন্টারনেট এবং একুশ শতকে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বিস্তার তথ্যের প্রবাহকে উন্মুক্ত করে দেয়। এসব মাধ্যমে তথ্য প্রচারে একদিকে যেমন সম্পাদনা ও প্রকাশনা নীতির কোনো বালাই নেই, অন্যদিকে প্রচারের স্থান-কাল নিয়েও নেই কোনো বাঁধাধরা।
মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকে যেখানে রাষ্ট্র ও সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়মে নির্দিষ্ট এলাকায় সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়, সেখানে ইন্টারনেট ভিত্তিক মাধ্যমগুলোতে প্রচারণার তেমন বিধিবদ্ধ আইনকানুনই নেই, যে কেউ চাইলেই বিশ্বের এক প্রান্তে বসে আরেক প্রান্তে যা ইচ্ছা তা প্রকাশ ও প্রচার করতে পারে।
এসব কারণে সম্প্রতি গুজব, ভুল তথ্য ও ভুয়া সংবাদ প্রচারের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। প্রযুক্তিগত কারণে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও এগুলো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও নিরসন সম্ভব নয়। তাই, ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ গণমাধ্যমের অভ্যন্তরীণ বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র পরিচয়ে নতুন ধারার গণমাধ্যম রূপে আবির্ভূত হচ্ছে, গড়ে উঠছে ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা।
বাংলাদেশেও ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ নিয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এদের অধিকাংশই স্বতন্ত্র ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা। পাশপাশি কিছু গণমাধ্যমও ফ্যাক্ট চেকিং নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। এই নিবন্ধে বাংলা ভাষায় ও বাংলাদেশে ফ্যাক্ট চেকিং নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN) স্বীকৃত এবং নির্ভরযোগ্য কিছু প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে।
বিডি ফ্যাক্ট চেক
বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেকিং কার্যক্রমের অন্যতম পথিকৃৎ “বিডি ফ্যাক্ট চেক”। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং দিবসে সংস্থাটি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। অলাভজনক, অরাজনৈতিক ও পেশাদার এই সংস্থার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে মিথ্যা, সন্দেহজনক ও ভুল তথ্যের প্রচার-প্রসার হ্রাস করা।
বিডি ফ্যাক্টচেক জাতিসংঘের উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা (ইউএনডিপি)-র আয়োজনকৃত ডিজিটাল খিচুড়ি চ্যালেঞ্জ-২০২০-এ চ্যাম্পিয়ন হয়। পুরষ্কার হিসেবে প্রাপ্ত অনুদান দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি করোনা ও ভুল তথ্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে, যা ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে।
এছাড়াও, মিডিয়া রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (MRDI) ও সুইডেন ভিত্তিক ফয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথভাবে ভুল তথ্য বিষয়ক সচেতনতায় কয়েকটি ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছে বিডি ফ্যাক্টচেক।
২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন পর্যবেক্ষণের জন্য ৩১টি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাকে সুযোগ দেওয়া হয়, যাদের অন্যতম ছিল বিডি ফ্যাক্টচেক। প্রতিষ্ঠানটি একাধিকবার আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং সম্মেলনেও অংশগ্রহণ করেছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় তিন শতাধিক গুজব ও ভুয়া সংবাদ চিহ্নিত করে সেগুলো নিয়ে নিজস্ব ওয়েবসাইটে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপ সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয়।
যাচাই
২০১২ সালে ‘সতর্ক থাকুন, দায়িত্বের সাথে শেয়ার করুন’ নামক ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা সংস্থাটি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘যাচাই’ নামে কার্যক্রম শুরু করে। ব্যক্তিগত অর্থায়নে পরিচালিত এই সংস্থা এক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় ছিল।
‘মিডিয়া ওয়াচ’ বা গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন ও ফটোকার্ডের জন্য সংস্থাটি পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রায় শতাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে বাংলাদেশে ফ্যাক্ট চেকিং ও সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।
🔗 Jachai
ফ্যাক্ট ওয়াচ
আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN) কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রথম ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা হচ্ছে ‘ফ্যাক্ট ওয়াচ’। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব)-র সেন্টার ফর ক্রিটিকাল এন্ড কোয়ালিটেটিভ স্টাডিজ (সিকিউএস)-র একটি প্রকল্প হিসেবে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে সংস্থাটি আত্মপ্রকাশ করে।
অলাভজনক এই সংস্থাটি প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশে অবস্থিত আমেরিকান সেন্টারের আর্থিক সহায়তায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে সংস্থাটি ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান ‘মেটা’-র বাংলাদেশ বিষয়ক অন্যতম ‘ফ্যাক্ট চেকিং পার্টনার’ হিসেবে কাজ করছে।
ভুল তথ্য, অপতথ্য, ভুয়া খবর এবং গুজবের বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে নিজস্ব ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি শিক্ষানবিশ সাংবাদিকদের ফ্যাক্ট চেকিংইয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতেও সংস্থাটি কাজ করছে।
রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ
বাংলাদেশের দ্বিতীয় ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা হিসেবে আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN) থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ’। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে সক্রিয় ও জনপ্রিয় এই ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাটি নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশের সাথে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ডিজিটাল ব্যানার প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
২০২০ সালের মার্চে কার্যক্রম শুরু করা এই সংস্থাটির ফেসবুক পেইজে প্রায় সাত লক্ষ অনুসারী এবং লক্ষাধিক সদস্যের একটি গ্রুপ রয়েছে, যা ফ্যাক্ট চেকিং নিয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কমিউনিটি। সম্প্রতি তারা হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন চালু করেছে, যেখানে পাঠকরা বিভিন্ন পোস্ট, ভিডিও এবং সংবাদের লিংক পাঠিয়ে ফ্যাক্ট চেকের অনুরোধ জানাতে পারবেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ইন্টারনেটে প্রচারিত ১০৮২টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে জড়িয়ে একই সময়ে ৭৪টি ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। বিগত আট মাসে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক (৪৩) ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে, যা মোট রাজনৈতিক ভুল তথ্যের ১৭ শতাংশ।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত এক হাজারের অধিক ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। ২০২২ সালে প্রায় ১৪০০-টি ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। এছাড়াও, ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদন নিয়ে নিয়মিত ভিডিও প্রচার করে থাকে।
বুম বাংলাদেশ
বুম বাংলাদেশ মূলত ভারতীয় ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ‘বুম লাইভ’ এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যা ২০২০ সালে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে। নিজস্ব ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেইজ, ইনস্টাগ্রাম, এক্স (টুইটার) ইত্যাদি মাধ্যমে সংস্থাটি ভুয়া তথ্যের বিস্তার রোধে কাজ করে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN) কর্তৃক স্বীকৃত এই সংস্থাটি বাংলাদেশে মেটার ‘থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট চেকিং পার্টনার’ হিসেবেও কাজ করে। ফ্যাক্ট চেকের অনুরোধ জানানোর জন্য তাদের হোয়াটসঅ্যাপ হেল্পলাইন আছে।
এএফপি ফ্যাক্ট চেক
ফরাসি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপি ২০১৭ সালে ফ্রান্সের নির্বাচন সম্পর্কিত ভুল তথ্য ও অপতথ্য মোকাবেলায় তাদের প্রকাশিত আলোচিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত কয়েকটি প্রতিবেদনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সেবছরই একটি ফ্যাক্ট চেকিং ও ডিজিটাল ইনভেস্টিগেশন টিম তৈরী করে এবং ফ্যাক্ট চেকিং কার্যক্রম শুরু করে।
এএফপি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২৬-টি ভাষায় ইন্টারনেটে ছড়ানো বিভিন্ন তথ্য পর্যবেক্ষণ করে থাকে। পরবর্তীতে স্থানীয় বা আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে প্রতিবেদন তৈরি ও সম্পাদনা এবং প্যারিস হেডকোয়ার্টার থেকে সমগ্র কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
এএফপি ফ্যাক্ট চেকের বাংলা বিভাগ বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি অধ্যুষিত অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পরা বিভিন্ন গুজব ও ভুল তথ্যের ফ্যাক্ট চেকের পাশাপাশি বহির্বিশ্বের আলোচিত বা ভাইরাল বিভিন্ন ঘটনা নিয়েও বাংলায় প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সায়েন্স বী । বিজ্ঞান সংবাদ
বাংলাদেশের বিজ্ঞান-বিষয়ক জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম সায়েন্স বী-র পোর্টাল ‘বিজ্ঞান সংবাদ’-এ বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন দাবির ফ্যাক্ট চেক করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও, বিভিন্ন দাবির বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে যথার্থতা নিরূপণেও প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে।
আজকের পত্রিকা
২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশের মূলধারার অন্যতম গণমাধ্যম ‘আজকের পত্রিকা’ ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। পত্রিকাটি তাদের ওয়েবসাইটের ফ্যাক্ট চেক সেকশনে দেশ, বিদেশ, জানি কিন্তু ভুল ইত্যাদি ভাগে নিয়মিত ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।
দেশীয় গণমাধ্যমগুলোর মাঝে সর্বপ্রথম বিজনেস স্টান্ডার্ড পত্রিকা বিডি ফ্যাক্ট চেকের সাথে ২০২০ সালে যৌথভাবে কিছুদিন ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন ছাপায়। বর্তমানে আরো কিছু গণমাধ্যমও ফ্যাক্ট চেক নিয়ে অনিয়মিতভাবে প্রতিবেদন ও ফটো কার্ড প্রচার করে থাকে।