ধরুন, একটি সংবাদমাধ্যমে একটি চাঞ্চল্যকর শিরোনাম প্রকাশিত হয়েছে যা হলো: “বিখ্যাত অভিনেত্রীর গোপন বিবাহ!” শিরোনামটি পাঠকদের মনে কৌতূহল জাগায় এবং সংবাদ পড়তে আগ্রহ সৃষ্টি করে। কিন্তু, ভেতরে গিয়ে দেখা যায় সংবাদটিতে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। আবার অভিনেত্রী নিজে বিবাহের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এ সংবাদ একদিকে সরাসরি মিথ্যেও বলছে না আবার অন্যদিকে সত্যও বলছে না। এই ধরনের সংবাদ প্রকাশই হলুদ সাংবাদিকতা।
বলা হয়ে থাকে- অসির চেয়ে মসির শক্তি বেশি। হলুদ সাংবাদিকতা তারই জলজ্যান্ত উদাহরণ। মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজের অবস্থান পোক্ত করা, অতিরঞ্জিত তথ্য দ্বারা পাঠক সমাজে চাঞ্চল্য তৈরি, পত্রিকার কাটতি বাড়ানো ইত্যাদি উদ্দেশ্যে হাসিলের জন্য ব্যবহারের মাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতার চর্চা অনুশীলন হয়। এগুলোর মাধ্যমে কাউকে কোনো প্রকার আঘাত হয় না। শুধু কলম চালিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করার সবচেয়ে সহজ উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাদামাটা খবরে মিথ্যার রঙ মিশিয়ে পরিবেশন করা হলো হলুদ সাংবাদিকতার মূলনীতি। এখানে সাধারণত প্রকৃত ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কৌশলে পাঠকের কাছে বানোয়াট তথ্যকে সত্য বলে প্রচার করার আদর্শ পন্থা।
সংজ্ঞা
সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ হিসেবে ধরা হয়। এ দর্পণে সাংবাদিকরা সমাজের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেন। স্বচ্ছা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি সংবাদ হতে হয় বস্তুনিষ্ঠ, সাংবাদিককে হতে হয় সতর্ক, যত্নবান ও পেশাদার। কিন্তু হলুদ সাংবাদিকতা এ আদর্শের বিপরীতপন্থী।
হলুদ সাংবাদিকতার সংজ্ঞা হিসেবে ‘সাংবাদিকতা’ শীর্ষক বইয়ে লেখক এ সাংবাদিকতার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি সংজ্ঞা দাড় করান এমন – অকারণে চমক সৃষ্টির উদ্দ্যেশ্যে অবাস্তব, ভিত্তিহীন, চটকদার ও চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশের চর্চাই হলো হলুদ সাংবাদিকতা।1বইঃ সাংবাদিকতা (১ম খন্ড), লেখকঃ আর রাজী, প্রকাশকঃ ভাষাচিত্র প্রকাশণী , পৃষ্ঠা ১৮১-১৮২
যুক্তরাষ্ট্রের Office Of The Historian ওয়েবসাইটে U.S. Diplomacy and Yellow Journalism, 1895–1898 শিরোনামের প্রতিবেদনে হলুদ সাংবাদিকতার সংজ্ঞায় বলে হয়েছে, হলুদ সাংবাদিকতা হলো সাংবাদিকতার এমন একটি ধরন যেখানে প্রকৃত ঘটনাকে উপেক্ষা করে সংবেদনশীল বিষয় গুলোর উপর জোর দেওয়া হয়।2 উদ্ধৃতিঃ “Yellow journalism was a style of newspaper reporting that emphasized sensationalism over facts.” প্রতিবেদনঃ U.S. Diplomacy and Yellow Journalism, 1895–1898, MILESTONES: 1866–1898,Office Of The Historian. অপরদিকে, অন্য আরেকটি সংজ্ঞায় এভাবে উল্লেখ করা হয়, হলুদ সাংবাদিকতা হলো কোনো ধরনের বিবেচনা ছাড়াই প্রকৃত ঘটনাকে অবহেলার সহিত অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন।3উদ্ধৃতিঃ “Yellow Journalism is a term used for the use of negligent and flamboyant newspaper reporting, without regard to facts.” গবেষণাঃ Yellow Journalism: Puncturing the Myths, Defining the Legacies Newspaper Research Journal, Fall 2003 by Strout, Lawrence N.
হলুদ সাংবাদিকতার আরেকটি মূল লক্ষণ হলো এখানে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অহেতুক বড় বড় শিরোনামের ব্যবহার করা হয়। অথচ, ভিতরে কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। আমরা এমন শিরোনাম প্রায়শই দেখি যেগুলো একনজর দেখলেই পুরো সংবাদ পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ‘ডিভোর্স হচ্ছে পূর্নিমার’- এমন শিরোনাম দেখে যে কেউ জানার চেষ্টা মূল সংবাদে আসলে কী বলতে চাচ্ছে। কিন্তু, মূল সংবাদে দেখা গেল এখানে সিনেমায় ডিভোর্সের কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে নয়। এটি একধরনের প্রতারণার সামিল। আজকাল আমাদের সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে অহরহ এমন চটকদার, ভুয়া সংবাদ দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া টাকা দিয়ে সংবাদ ছাপাতেও দেখা যায়। এক্ষেত্রে সংবাদের যথার্থতা বিবেচনায় রাখা হয় না। বরং নজর থাকে পকেটের দিকেই। কিছু অসাধু সাংবাদিকদের এমন হীন চর্চা আজও হলুদ সাংবাদিকতাকে লালন করছে। তথ্যের যথার্থতার চেয়ে অর্থ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কে কার চেয়ে বেশি আয় করবে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে। কার আগে কে পাঠক আকৃষ্ট করবে তার প্রতিযোগিতাই এখানে মুখ্য। এমনই এক প্রতিযোগিতার হাত ধরে এসেছিল হলুদ সাংবাদিকতা।
ইতিহাসের পাতায়, হলুদ সাংবাদিকতার সূচনা হয় আমেরিকায়। তৎকালীন সময়ে আমেরিকার দুটো জনপ্রিয় সংবাদপত্রের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে উৎপত্তি হয় আজকের হলুদ সাংবাদিকতা।
হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাস
শুরুটা হয় উনবিংশ শতাব্দির শেষ থেকে। আমেরিকার পত্রিকাগুলোতে আসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের অন্তরালে যাদের নাম জ্বলজ্বল করছে তারা হলেন বিখ্যাত দুই সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম র্যাডলফ হার্সট।
জোসেফ পুলিৎজারের জন্ম ১৮৪৭ সালে হাঙ্গেরিতে।4বইঃ সাংবাদিকতা শিকড় থেকে শিখর, লেখকঃ শাহেদ জাহিদী, প্রকাশকঃ পলল প্রকাশণী, প্রকাশকালঃ ২০১৬ ১৮৬৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ১৮৮৩ সালে জে গোল্ড নামক এক শিল্পপতির কাছ থেকে ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকাটি কিনে নেন। সেই সময় পত্রিকাটির সার্কুলেশন ছিল পনেরো হাজার। তখন পুলিৎজার ঘোষণা দেন- এই পত্রিকাটির উপজীব্য হবে চাঞ্চল্য, গালগল্প, কেলেঙ্কারি জাতীয় সংবাদ।5বইঃ সাংবাদিকতা (১ম খন্ড), লেখকঃ আর রাজী, প্রকাশকঃ ভাষাচিত্র প্রকাশণী , পৃষ্ঠা ১৮১-১৮২
পরবর্তীতে, সত্যি সত্যিই চটকদার গল্প ও আদর্শিক ভাবনার মিশ্র পরিবেশ দেখা যায় পত্রিকাটিতে। তিন বছরের মাথায় নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের সার্কুলেশন আড়াই লাখে পৌঁছায়। এই সাফল্যের পেছনে প্রযুক্তির অগ্রগতি বিশেষ অবদান রাখে। সেই সময় হো প্রেস নামক একটি মুদ্রণযন্ত্র ছিল যেটি ঘন্টায় বাহাত্তর হাজার পত্রিকা ছাপাতে, কাটতে ও ভাঁজ করার সক্ষতা ছিল। এ সুযোগকে কাজে লাগান জনাব পুলিৎজার। পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অসৎ উপায় অবলম্বন করার পথ বেছে নেন। প্রথম পৃষ্ঠায় অহেতুক বড় বড় শিরোনাম দেওয়া থেকে শুরু করে তিলকে তাল বানিয়ে ছাপানো সবই হতো পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডে।
অন্যদিকে, একই সময়ে দেখা যায় সাংবাদিকতার জগতে আমেরিকার ধনকুবের উইলিয়াম হার্সট এর আগমন। তিনি ‘মর্নিং জার্নাল’ কিনে পত্রিকাটির প্রচার ও প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। আর এ লক্ষ্য অর্জনে তিনিও চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশনকেই মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে, তার পদ্ধতি ছিল কিছুটা ভিন্ন। তিনি তার প্রতিবেদকদের নির্দেশ দেন চাঞ্চল্যকর সংবাদ অনুসন্ধানের জন্য৷ এরই ফলস্বরূপ তার এক নারী সংবাদকর্মী পতিতাদের দলে মিশে গিয়েছিলো তাদের অভ্যন্তরীণ তথ্য সংগ্রহ করতে। আরেক সংবাদকর্মী পাগলা গারদের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে গারদে নাম লিখিয়ে ছিলেন। সেই হার্সট এর হাত ধরেই এসেছে আমাদের বর্তমানের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ধারণা।6বইঃ সাংবাদিকতা শিকড় থেকে শিখর, লেখকঃ শাহেদ জাহিদী, প্রকাশকঃ পলল প্রকাশণী, প্রকাশকালঃ ২০১৬ তবে এখানেও ছিল সত্য মিথ্যার মিশেল। অল্প সময়েই মর্নিং জার্নালের সার্কুলেশন এসে বাহাত্তর হাজারে দাঁড়ায়।
কে কার চেয়ে বেশি পাঠক তার পত্রিকার দিকে টেনে আনবে এই নিয়ে শুরু হয় দুই পত্রিকার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এরই ধারাবাহিকতায় পুলিৎজার তার নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডে ‘হোগান’স অ্যালি’- নামে একটি কমিক স্ট্রিপ চালু করেন। এই কমিক স্ট্রিপের একটি চরিত্র ছিল হলুদ জোব্বা পরা এক বালক। এই বালক পরিচিত ছিল ‘ইয়েলো কিড’ নামে। ইয়েলো কিডের কার্টুনিস্ট ছিলেন রিচার্ড এফ. আউটকল্ট। তৎকালীন সমসাময়িক বিষয়গুলোকে ব্যঙ্গাত্মক উপায়ে উপস্থাপন করা হতো ইয়েলো কিডের মাধ্যমে। পাঠকরা এ কমিক খুব আগ্রহ নিয়ে প্রতিনিয়ত পড়তেন। যার ফলে, হুরহুর করে বেড়ে যেতে লাগে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের বিক্রি। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাজারে আধিত্য স্থাপনের লক্ষ্যে হার্সট বিপরীত পরিকল্পনা অনুসরণ করে। তিনি অধিক বেতন দিয়ে আউটকল্টকে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড থেকে নিয়ে আসেন মর্নিং জার্নালে। আউলকল্টক চলে গেলেও পুলিৎজার ইয়েলো কিড এর প্রকাশনা বন্ধ করেননি। নতুন কার্টুনিস্ট নিয়োগ দিয়ে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডে ইয়ালো কিড এর ধারাবাহিকতা চালিয়ে যান। দুই পত্রিকার ইয়েলো কিড নিয়ে এমন দ্বন্দ্ব থেকেই নামকরণ আসে ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা।7প্রতিবেদনঃ U.S. Diplomacy and Yellow Journalism, 1895–1898, MILESTONES: 1866–1898,Office Of The Historian.
হলুদ সাংবাদিকতার বিবর্তন
‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ ও ‘মর্নিং জার্নাল’ এর দ্বন্দ্ব মোটেও কোনো সাধারণ দ্বন্দ্ব ছিল না। নিজেদের পত্রিকার কাটতি বাড়াতে তারা সকল ধরনের হীন কাজ করে বেড়াতো। তাদের কর্মকাণ্ড খুনাখুনির পর্যায় পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। তারা একে অন্য পত্রিকার সংবাদ প্রতিনিধিদের হত্যা করতো।প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায়, এক পাঠককেই হত্যা করে ফেলেছিল হার্সটের ভাড়াটে গুন্ডারা। ঐ পাঠকের অপরাধ কেবল এইটুকুই ছিল, তিনি মর্নিং জার্নাল না পড়ে অন্য এক পত্রিকা পড়ছিলেন। তাই ওই সংবাদপত্র পাঠরত অবস্থাতেই তাকে হত্যা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও স্পেন যুদ্ধেও ভূমিকা রেখেছে এই দুই বিখ্যাত সাংবাদিকের তৈরিকৃত হলুদ সাংবাদিকতা। দীর্ঘকাল ধরে কিউবাতে স্প্যানিশ উপনিবেশ চলে আসছিল। এই নিয়ে উনিশ শতকের বেশিরভাগ সময় জুড়েই চলছিল বিপ্লবী আন্দোলন। ১৮৯০ সালে এই আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। সেই সময় পুলিৎজার ও হার্সট উভয়ই কিউবাকে সমর্থন দিয়ে নানান সংবাদ ছাপাতে থাকেন নিজেদের পত্রিকায়। বোল্ড ফন্টের বড় বড় শিরোনাম, সৃজনশীল চিত্রাঙ্কন দিয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন তারা। এতে করে তাদের পত্রিকার কাটতিও বাড়তে থাকে। এছাড়া আন্দোলন নিয়ে ছড়াতে থাকে বানোয়াট গল্প, যেগুলো পরবর্তীতে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।8প্রতিবেদনঃ U.S. Diplomacy and Yellow Journalism, 1895–1898, MILESTONES: 1866–1898,Office Of The Historian.
১৯৯৮ সালে স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝের সম্পর্ক উন্নত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাইন’ নামক একটি যুদ্ধ জাহাজ পাঠানো হয় স্পেনে। জাহাজটি কিউবার হ্যাভানা বন্দরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু, ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখে দুর্ঘটনাবশত জাহাজে একটি বিস্ফোরণ ঘটে এবং জাহাজটি ডুবে যায়। কিন্তু স্পেন বিরোধী পুলিৎজার ও হার্সট বিস্ফোরণের জন্য সরাসরি স্পেনকে দায়ী করে বসে যার ফলে তৈরি হতে থাকে স্পেন বিরোধী জনমত। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র স্পেনকে আক্রমণ করে। দুই দেশের মাঝে শুরু হয় যুদ্ধ। পরবর্তীতে, যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তে দেখা যায়, মাইন নামক সেই জাহাজের বিস্ফোরণে স্পেনের কোনো যোগসূত্রই ছিল না বরং, সেই বিস্ফোরণটি ছিল কেবলই একটি দুর্ঘটনা।9প্রতিবেদনঃ U.S. Diplomacy and Yellow Journalism, 1895–1898, MILESTONES: 1866–1898,Office Of The Historian.
হলুদ সাংবাদিকতার গেঁড়াকলে এমন আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে যা আন্তর্জাতিক মহলে হৈচৈ এনে দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে এবিসি নিউজ একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, তৎকালীন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু প্রতারক বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্তে অভিযোগটি মিথ্যা প্রমানিত হয়।10গবেষণাঃ Yellow Journalism: Puncturing the Myths, Defining the Legacies Newspaper Research Journal, Fall 2003 by Strout, Lawrence N.
এছাড়াও ২০০৩ সালের ইরাক-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের সাথেও যোগসূত্র আছে হলুদ সাংবাদিকতার। সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস এর সাংবাদিক জুডিথ মিলার ও অন্যান্য বিশিষ্ট মূলধারার সাংবাদিকগণ সাদ্দাম বিরোধী সংবাদ প্রচারে তৎপর ছিলেন। সেই সকল সংবাদে বলা হয় সাদ্দাম হোসেন আল কায়েদা নামক সংগঠনটির সাথে যুক্ত। আরও বলা হয় ৯/১১-তে আল কায়দার হামলায় সাদ্দাম হোসেনের যোগসূত্র থাকতে পারে। এছাড়াও তারা বলে, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে এবং সাদ্দাম হোসেন একটি পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরীতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এই সকল সংবাদ সরাসরি যুদ্ধের কারণ না হলেও সেই সময়ের জন্য অন্যতম উপজীব্য হিসেবে কাজ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই সংবাদগুলোর সত্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।11অনুচ্ছেদঃ “Yes, the Press Helps Start Wars”, cato.org
সম্প্রতিকালে হলুদ সাংবাদিকতার নজির দেখতে পাওয়া যায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত পশ্চিমা মিডিয়া গুলোর প্রতিবেদনে। যেখানে সাংবাদিকতা হওয়ার কথা পক্ষপাতশূন্য, সেখানে তাদের একপাক্ষিক ভাবে ইসরায়েলি সমর্থন সুস্পষ্ট। পশ্চিমা মিডিয়ার অন্যতম শক্তিশালী গণমাধ্যম বিবিসি-এর প্রতিবেদনগুলোতে দেখা যায়, তারা ফিলিস্তিনের হামলাকে উপেক্ষা করে ইসরায়েলে হতাহতের ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছে। এছাড়াও দুইদেশের মাঝে এ দ্বন্দ্বকে ‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ’ না বলে ‘ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ’ বলে প্রচার করছে তারা। একইসাথে, তারা বলছে ইসরায়েল নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য হামলা চালিয়েছে।12অনুচ্ছেদঃ “Experts Slam BBC for Biased Coverage of Gaza Escalation”, en.sputniknews.africa অথচ, বাস্তবতার সাথে মিল খুঁজতে গেলে উপরের সবকটি তথ্যই অসত্য ও ইসরায়েল সমর্থিত বলে প্রমানিত হয়।
বাংলাদেশে হলুদ সাংবাদিকতা
সালটা ছিল ১৯৭৪। সবে মাত্র দেশ স্বাধীন হলো। এরই মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগ- বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, দুর্ভিক্ষের কবলে বাংলাদেশের মানুষ। ঘরে ঘরে দুর্ভিক্ষের ছোঁয়া, শত শত মানুষ তখন অভুক্ত মরণ ছোবলে। এমন দুর্ভোগের সময় দৈনিক ইত্তেফাকে একটি ছবি প্রকাশিত হয়। যেখানে দেখা যায় বাসন্তি নামক একজন নারী লজ্জা নিবারণ করতে ছেঁড়া শাড়ির উপর মাছের জাল পরিধান করে কলা গাছের ভেলায় চড়ে কলাগাছের পাতা সংগ্রহ করছেন। বন্যার পানিতে বাসন্তির চাচাতো বোন দূর্গতি রাণী বাঁশ হাতে ভেলার অন্য প্রান্তে বসে ভেলাটিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। জাল পরা বাসন্তির এই ছবি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব মানবতার মনেও হাহাকার তৈরি করে। তখন দেশ পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে জনগণদের মাঝে।13প্রতিবেদনঃ ‘মনে পড়ে সেই বাসন্তিকে’, জাগো নিউজ ডটকম পরবর্তীতে, যখন এ বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা ও তদন্ত হয় তখন বেড়িয়ে আসে থলের বিড়াল। দেখা যায়, সরকারকে বেকায়দা ফেলার জন্যই সরকার বিরোধীদের সাথে মিলে পরিকল্পিতভাবে ছবিটি তোলেন তৎকালীন দৈনিক ইত্তেফাকের আলোকচিত্রী আফতাব উদ্দিন।14প্রতিবেদনঃ ‘মনে পড়ে সেই বাসন্তিকে’, জাগো নিউজ ডটকম এ ঘটনা পড়েই বোঝা যায় বাংলাদেশে হলুদ সাংবাদিকতার চর্চা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে।
আরেকটি ঘটনা জানা যাক। ২০১৭ সালের জুন মাসের ২ তারিখ, রাঙামাটি জেলার লংদুতে একটি ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সেখানে প্রায় শতাধিক ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠলেও কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটে নি। কিন্তু দেশের প্রথম সারির একটি বাংলা পত্রিকাতে বলা হয় গুণমালা চাকমা নামে ৭০ বছরের এক উপজাতি বৃদ্ধা আগুনে পুড়ে মারা গেছে। অথচ পরবর্তীতে এর কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় নি।15প্রতিবেদনঃ ‘সবুজ পাহাড় নিয়ে কেন এত হলুদ সাংবাদিকতা?’, পার্বত্য নিউজ
উপরের দুটো ঘটনাতেই সত্যতার কোনো ছোঁয়া না থাকলেও আছে চাঞ্চল্য তৈরী করার উপাদান। প্রতিদিনের সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের সংবাদগুলো পর্যালোচনা করলে এমন অহরহ হলুদ সাংবাদিকতার উদাহরণের দেখা মিলবে।
বাংলাদেশের মত একটি অভাবী দেশে হলুদ সাংবাদিকতা খুবই সহজ একটি বিষয়। এখানে সাংবাদিকতার আবহ শুরু থেকে এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যে আইডিকার্ড দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে সংবাদ করা রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এর একটি বড় কারণ হলো সাংবাদিকদের স্বল্প বেতন প্রদান। অনেক হাউজে নতুন প্রতিবেদকদের বেতনও দেওয়া হয় না। ফলে অনেক সাংবাদিকগণ নিজের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে এমন হীন চর্চায় লিপ্ত হতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশে হলুদ সাংবাদিকতার আরও একটি বড় কারণ হলো সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন ছাড়াও সাংবাদিক হওয়ার সুযোগ আছে এখানে। কাঁধে ক্যামেরা হাতে মাইক নিয়ে যে কেউ শুরু করে দিতে পারেন লাইভ, রিপোর্টিং। প্রযুক্তির বদৌলতে তৈরি করতে পারেন নিজস্ব পাঠক বা দর্শক গোষ্ঠী। এর জন্য প্রয়োজন নেই কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় অনুমতির। স্বজনপ্রীতির প্রভাবে মূলধারার গণমাধ্যমে যোগ দেওয়া খুবই সহজ কাজ এই দেশে। অথচ তারা কেউই জানেন না সাংবাদিকতার রীতিনীতি, আইনকানুন। ফলে জনগণের বিশ্বাস নিয়ে লিপ্ত হন স্বেচ্ছাচারিতায়। তথ্য যাচাই না করেই তৈরি করেন সংবাদ। অন্যের সংবাদ চুরি করে বা হালকা ঘষামাজা করে ঘরে বসেই প্রকাশ করেন গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রতিবেদন। আবার সম্পাদনায় এমন মানুষও দেখা যায় যার সম্পাদনা নিয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। অথচ সাংবাদিকতার জগতে একজন সম্পাদক হলেন ‘সীমান্তের শেষ ফাঁড়ি’। এসব বিষয় নজরে রাখার জন্য বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল থাকলেও আইন প্রয়োগে বা হলুদ সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণে তাদের উদাসীনতা লক্ষ্যণীয়। এরই সুযোগ নিয়ে তৈরি হচ্ছে অসচেতন সাংবাদিক সমাজ। এতে করে যারা সুষ্ঠু সাংবাদিকতার চর্চা করেন তারাও হারাচ্ছেন পাঠকের বিশ্বস্ততা।
হলুদ সাংবাদিকতা হলো সাংবাদিকতার একটি রূপ যেখানে রোমাঞ্চকর, রহস্যময়, অশ্লীল, অথবা সহিংস ঘটনার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হলো পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং বিক্রয় বাড়ানো। এই ধরনের সাংবাদিকতা প্রায়শই তথ্যের বিকৃতি, অসত্য তথ্য প্রচার, এবং আবেগের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। হলুদ সাংবাদিকতার নেতিবাচক প্রভাব অনেক। এটি সমাজে ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে, জনমতকে বিভ্রান্ত করতে পারে, এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি নষ্ট করতে পারে।
হলুদ সাংবাদিকতার জনক পুলিৎজার ও হার্সট কেবল হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম দিয়েই ক্ষান্ত হননি। একদিকে যেমন ক্ষতি করেছেন তেমনি অন্যদিকে সাংবাদিকতা জগৎকে করেছেন সমৃদ্ধ। হলুদ সাংবাদিকতার পাশাপাশি হার্সটের সময়েই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সম্প্রসারণ হয়। চাঞ্চল্যকর সংবাদ সংগ্রহে হার্সট অনুসন্ধানের উপর জোর দিতেন। অন্যদিকে ‘পুলিৎজার পুরস্কার’ আজ পর্যন্ত সাংবাদিকতার জগতে একটি অন্যতম মূল্যবান পুরস্কার হিসেবে বিখ্যাত। এই দুই বিখ্যাত সাংবাদিকের হলুদ সাংবাদিকতা চর্চার মূলকারণ ছিল পত্রিকার কাটতি বাড়িয়ে যশ ও খ্যাতি অর্জন।
কিন্তু, আমাদের দেশের দিকে তাকালে হলুদ সাংবাদিকতা চর্চার একমাত্র কারণ পকেট ভারী করা। এছাড়া কাউকে ভয় দেখানো, জিম্মি করে রাখার মত কাজেও ব্যবহার করা হয় হলুদ সাংবাদিকতাকে। বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে কাউকে বানিয়ে দেওয়া হয় নায়ক, আবার কেউ হয়ে যায় খলনায়ক।16বইঃ সাংবাদ শিকড় থেকে শিখর, লেখকঃ শাহেদ জাহিদী, প্রকাশকঃ পলল প্রকাশণী, প্রকাশকালঃ ২০১৬
সাংবাদিকতায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটো বিষয়। কিন্তু এই দুটো বিষয়ই যখন অর্থ ও ব্যক্তিস্বার্থের কাছে বিক্রি হয়ে যায় তখন তার রঙ হয়ে যায় হলুদ। একজন সাংবাদিক কাজ করেন মানুষ নিয়ে, মানুষের জন্যে। কিন্তু হলুদের আভায় এই গণমানুষের বিশ্বস্ততাই যদি হারিয়ে যায়, তবে সাংবাদিকতার জন্য তা কেবল লজ্জারই নয়, আতংকেরও বটে।
তথ্যসূত্র - References
- 1বইঃ সাংবাদিকতা (১ম খন্ড), লেখকঃ আর রাজী, প্রকাশকঃ ভাষাচিত্র প্রকাশণী , পৃষ্ঠা ১৮১-১৮২
- 2উদ্ধৃতিঃ “Yellow journalism was a style of newspaper reporting that emphasized sensationalism over facts.” প্রতিবেদনঃ U.S. Diplomacy and Yellow Journalism, 1895–1898, MILESTONES: 1866–1898,Office Of The Historian.
- 3উদ্ধৃতিঃ “Yellow Journalism is a term used for the use of negligent and flamboyant newspaper reporting, without regard to facts.” গবেষণাঃ Yellow Journalism: Puncturing the Myths, Defining the Legacies Newspaper Research Journal, Fall 2003 by Strout, Lawrence N.
- 4বইঃ সাংবাদিকতা শিকড় থেকে শিখর, লেখকঃ শাহেদ জাহিদী, প্রকাশকঃ পলল প্রকাশণী, প্রকাশকালঃ ২০১৬
- 5বইঃ সাংবাদিকতা (১ম খন্ড), লেখকঃ আর রাজী, প্রকাশকঃ ভাষাচিত্র প্রকাশণী , পৃষ্ঠা ১৮১-১৮২
- 6বইঃ সাংবাদিকতা শিকড় থেকে শিখর, লেখকঃ শাহেদ জাহিদী, প্রকাশকঃ পলল প্রকাশণী, প্রকাশকালঃ ২০১৬
- 7প্রতিবেদনঃ U.S. Diplomacy and Yellow Journalism, 1895–1898, MILESTONES: 1866–1898,Office Of The Historian.
- 8প্রতিবেদনঃ U.S. Diplomacy and Yellow Journalism, 1895–1898, MILESTONES: 1866–1898,Office Of The Historian.
- 9প্রতিবেদনঃ U.S. Diplomacy and Yellow Journalism, 1895–1898, MILESTONES: 1866–1898,Office Of The Historian.
- 10গবেষণাঃ Yellow Journalism: Puncturing the Myths, Defining the Legacies Newspaper Research Journal, Fall 2003 by Strout, Lawrence N.
- 11অনুচ্ছেদঃ “Yes, the Press Helps Start Wars”, cato.org
- 12অনুচ্ছেদঃ “Experts Slam BBC for Biased Coverage of Gaza Escalation”, en.sputniknews.africa
- 13প্রতিবেদনঃ ‘মনে পড়ে সেই বাসন্তিকে’, জাগো নিউজ ডটকম
- 14প্রতিবেদনঃ ‘মনে পড়ে সেই বাসন্তিকে’, জাগো নিউজ ডটকম
- 15প্রতিবেদনঃ ‘সবুজ পাহাড় নিয়ে কেন এত হলুদ সাংবাদিকতা?’, পার্বত্য নিউজ
- 16বইঃ সাংবাদ শিকড় থেকে শিখর, লেখকঃ শাহেদ জাহিদী, প্রকাশকঃ পলল প্রকাশণী, প্রকাশকালঃ ২০১৬