সভ্যতার গঠন-উত্থান, সংস্কৃতির বিবর্তন-বিকাশ, যোগাযোগের মাধ্যমেই এসবের গোড়াপত্তন। নিজেদের প্রয়োজন বা উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম হিসেবে সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ যোগাযোগের আশ্রয় নিয়েছে। আদিম যুগের মানুষ ইশারা বা সাংকেতিক ভাষায় যোগাযোগ করতেন। মৌখিক ভাষার বিকাশ ঘটলে কথোপকথনই হয়ে উঠে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। চিহ্ন আর বর্ণমালা আবিষ্কারের পর প্রচলন ঘটে লিখিত যোগাযোগের।
সভ্যতার ক্রমবিকাশ আর প্রযুক্তিগত বিপ্লবের ফলে যোগাযোগ মাধ্যমেরও পরিবর্ধন-উন্নয়ন হয়। পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া – এসবই এখন যোগাযোগের মাধ্যম। ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইস ভিত্তিক এসব মাধ্যম যোগাযোগকে করেছে আরো গতিশীল, আরো কার্যকর।
যোগাযোগের ধারণা – Concept of Communication
‘যোগাযোগ’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Communication’, যার উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘Communis’ (কমিউনিস) থেকে। কমিউনিস শব্দের অর্থ হলো সাধারণ। মূলত ‘Communis’ শব্দটি বিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় ‘Communicare’-এ, যার অর্থ to share, অংশ নেয়া বা দেয়া।
ল্যাটিন ‘Communicare’ থেকে উদ্ভব ‘Communicatio’; একবচনে ‘Communicationem’, এর অর্থ imparting, সংযোগ। ‘Communicatio’ থেকে প্রাচীন ফ্রেঞ্চ ভাষায় যুক্ত হয় ‘Communicacion’ শব্দটি, যা থেকে ইংরেজি ‘Communication’ শব্দের জন্ম। এক্ষেত্রে Communication তথা যোগাযোগের আক্ষরিক অর্থ সংযোগ।
সাধারণত চিন্তা-ভাবনা, তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে সংযোগ বা সম্পর্ক সৃষ্টি করাই যোগাযোগ। নিজের সাথে নিজের কিংবা দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মাঝে কথোপকথন, ভাব-বিনিময়ের মাধ্যমে, এমনকি যন্ত্র থেকে যন্ত্রে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমেও যোগাযোগ হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে যোগাযোগ একটি প্রক্রিয়া (Process), যার মাধ্যমে চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, তথ্য ইত্যাদির পারস্পরিক আদান-প্রদান হয়। এই প্রক্রিয়ায় যিনি প্রেরণ করেন, তাকে প্রেরক (Sender); যা প্রেরণ করা হয়, তা বার্তা (Message); যার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়, তিনি গ্রাহক (Receiver) এবং বার্তা গ্রহণের পর গ্রাহকের প্রতিক্রিয়াকে ফলাফল বা ফলাবর্তন (Feedback) বলা হয়।
এখন হয়তো আপনি আপনার মস্তিষ্ককে বলছেন, এই নিবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পড়তে! অর্থাৎ আপনি আপনার নিজের সাথেই যোগাযোগ করছেন। এক্ষেত্রে আপনি প্রেরক, আপনার মস্তিষ্ক গ্রাহক, “এই নিবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পড়তে” বলা বার্তা আর পড়ার মাধ্যমে যখন মনে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটি ফলাফল বা ফলাবর্তন।
আবার আপনি আপনার সহপাঠীকে যখন এই নিবন্ধটি পড়তে বলছেন, তখনো যোগাযোগ হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনি প্রেরক হলেও আপনার সহপাঠী হবেন গ্রাহক।
গল্প-উপন্যাসের কোনো সংলাপ বা চরিত্রের মাঝে পাঠকের নিজেকে খুঁজে পাওয়াও একজন লেখকের জন্য যোগাযোগ; একজন সাংবাদিকের জন্য যোগাযোগ হচ্ছে দর্শকের কাছে সঠিক সংবাদ উপস্থাপন; একজন কূটনৈতিক যোগাযোগ করে এক দেশের সাথে অন্য দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে।
বস্তুত, যোগাযোগের পরিধি অসীম। দৈনন্দিন জীবনের সর্বব্যাপী যোগাযোগের অস্তিত্ব বিদ্যমান। পরিস্থিতিভেদে যোগাযোগের প্রক্রিয়াও ভিন্ন ভিন্ন।
যোগাযোগের সংজ্ঞা – Definition of Communication
দুপক্ষের মাঝে বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যমে মিথস্ক্রিয়া তথা পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ককেই সাধারণ ভাষায় যোগাযোগ বলা যেতে পারে।
ক্যামব্রিজ একাডেমিক কন্টেন্ট ডিকশনারি-তে বলা হয়েছে, যোগাযোগ হচ্ছে “সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে কিংবা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে বার্তা বা তথ্য প্রেরণ করা হয় অথবা বার্তা নিজেই পৌঁছে যায়।”1উদ্ধৃতি: “the process by which messages or information is sent from one place or person to another, or the message itself”; অভিধান: Cambridge Academic Content Dictionary; প্রকাশক: Cambridge University Press; আরো বলা হয়েছে, “তথ্যের আদান-প্রদান এবং অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের ফলস্বরূপ যে পারস্পরিক বোঝাপড়া হয়, তাই যোগাযোগ।”2উদ্ধৃতি: “Communication is also the exchange of information and the expression of feeling that can result in understanding”; অভিধান: Cambridge Academic Content Dictionary; প্রকাশক: Cambridge University Press;
এখানে ‘বার্তা নিজেই পৌঁছে যায় (the message itself)’ বলতে বুঝানো হয়েছে, প্রেরক থেকে সরাসরি বার্তা পাঠানো ছাড়াই গ্রাহক যখন পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজেই কোন বার্তা গ্রহণ করে। যেমন, আকাশ মেঘলা হলে আমরা ধরে নেই, বৃষ্টি হবে! যদিও আকাশ থেকে আমাদের কাছে সরাসরি কোন বার্তা পৌঁছানো হয় নি, পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা (গ্রাহক) মেঘলা আকাশকে বৃষ্টির পূর্বাভাস (বার্তা) হিসেবে গ্রহণ করেছি। এক্ষেত্রে প্রেরক ছাড়াই কেবল বার্তার মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে।
অক্সফোর্ড এডভান্সড লার্নারস ডিকশনারি-তে যোগাযোগকে বলা হয়েছে, “চিন্তা ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ অথবা মানুষকে বার্তা দেয়ার প্রক্রিয়া বা কার্যক্রম।”3উদ্ধৃতি: “the activity or process of expressing ideas and feelings or of giving people information”; অভিধান: Oxford Advanced Learner’s Dictionary; প্রকাশক: Oxford University Press;
ম্যারিয়াম-ওয়েবস্টার অভিধান মতে যোগাযোগ হচ্ছে “এমন একটি প্রক্রিয়া, যাতে প্রচলিত প্রতীক, চিহ্ন বা আচরণের মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গের মাঝে তথ্যের আদান-প্রদান হয়।”4উদ্ধৃতি: “a process by which information is exchanged between individuals through a common system of symbols, signs, or behavior”; অভিধান: Merriam-Webster.com; প্রকাশক: Merriam-Webster, Inc.;
বিশিষ্ট যোগাযোগবিদ ডেভিড কে. বার্লো যোগাযোগের ধারণা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “প্রেরক ও গ্রাহক, উভয়য়ের কাছেই বার্তাকে সমার্থক রাখা, চিন্তাধারার দূরত্ব কমিয়ে দু’টি জীব সত্তাকে পারস্পরিক সংযুক্ত করার যে প্রচেষ্টা, তারই প্রতিনিধিত্ব করে যোগাযোগ।”5উদ্ধৃতি: “Communication represents and attempts to couple two organisms, to bridge the gap between two individuals’ thought, the production and reception of message which have meaning for both”; লেখক: David K. Berlo;
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ জুডি সি. পিয়ারসন এবং পল ই নেলসন তাঁদের বইয়ে লিখেছেন, “যোগাযোগকে এমন এক প্রক্রিয়া হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, ধরনের অর্থবোধকতা তৈরিতে বার্তাকে ব্যবহার করা হয়। যোগাযোগকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনার কারণ হচ্ছে এটি এক ধরনের কার্যকলাপ, এক ধরনের বিনিময় কিংবা বিভিন্ন ধরনের আচরণের এক সমষ্টি – বিনিময়ের অযোগ্য কোন বস্তু নয়।”6উদ্ধৃতি: “Communication is defined as the process of using messages to generate meaning. Communication is considered a process because it is an activity, an exchange, or a set of behaviors – not an unchanging product.”; গ্রন্থ: Human Communication; লেখক: Judy C. Pearson, Paul E. Nelson, Scott Titsworth, Lynn Harter;
স্যার আলফ্রেড জুলস ফ্রেডি এয়ের লিখেছেন, “যোগাযোগ শব্দটি আমরা ব্যবহার করি – কখনো কি পাঠানো হয়েছে বুঝাতে, কখনো কীসের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে জানতে, কখনো আবার এর পুরো প্রক্রিয়াকে বুঝাতে। অনেক ক্ষেত্রে, পাঠানোর এই প্রক্রিয়াটি অব্যাহতভাবে চলমান থাকে; আমি যদি একজন ব্যক্তিকে কোন তথ্য জানাই, তবে সেই তথ্যে আমার অধিকার হারিয়ে যায় না, বরং উভয়ে সংযুক্ত হই। এভাবেই যোগাযোগ শব্দটি অংশগ্রহণমূলক চেতনাকেও ধারণ করে।”7উদ্ধৃতি: “We use the word ‘communication’ sometimes to refer to what is so transferred, sometimes to the means by which it is transferred, sometimes to the whole process. In many cases, what is transferred in this way continues to be shared; if I convey information to another person, it does not leave my own possession through coming into his. Accordingly, the word ‘communication’ acquires also the sense of participation.”; প্রবন্ধ: What is Communication?; লেখক: Alfred Jules Freddie Ayer;
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলো পর্যালোচনা করে বলা যায়, যোগাযোগ হচ্ছে বার্তা কেন্দ্রিক এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে বার্তার প্রেরক ও গ্রাহকের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও সংযোগ সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যোগাযোগের সংজ্ঞা
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ডেভিড কে বার্লো (David. K. Barlo) যোগাযোগ বা ‘Communication’-কে একটি বহুমাত্রিক এবং বিভ্রান্তিকর শব্দ বলে অভিহিত করেছেন। মার্কিন দার্শনিক জন ফিস্ক (John Fiske) লিখেছেন, “মানবীয় যেসব আচরণকে সকলেই স্বীকার করে কিন্তু স্বল্পসংখ্যকই পারে সংজ্ঞায়িত করতে, যোগাযোগ তাদের অন্যতম।”8উদ্ধৃতি: “Communication is one of those human activities that everyone recognizes but few can define satisfactorily”; গ্রন্থ: Introduction to Communication Studies; লেখক: John Fiske; প্রকৃতপক্ষে যোগাযোগের পরিধি এতই ব্যাপক যে একে নির্দিষ্ট কোন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিপূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব।
যোগাযোগ বিষয়ক লেখক ও গবেষক থমাস আর নিলসেন তাঁর “On Defining Communication” প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যোগাযোগ’ শব্দটির অর্থ একই সাথে স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট – উভয়ই। প্রচলিত অর্থে ‘যোগাযোগ’ যথেষ্ট স্পষ্ট, কিন্তু যখনই আমরা যোগাযোগের প্রায়োগিক সীমারেখা নির্ধারণের চেষ্টা করি, যোগাযোগ বিষয়টি দুর্বোধ্য হয়ে যায়।”9উদ্ধৃতি: “The meaning of the word ‘communication’ is at once both clear and obscure. It is clear enough in conventional usage, but obscure when we seek to determine the limits of its application”; প্রবন্ধ: On Defining Communication; লেখক: Thomas R Nilsen;
বিশিষ্ট যোগাযোগবিদ কেনেথ কে. সেরেনো এবং সি. ডেভিড মর্টেনসেন তাঁদের Foundations of Communication Theory গ্রন্থের ‘Communication Theory: Perspective’ অধ্যায়ে থমাস আর নিলসেনের এই প্রবন্ধটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, গবেষকগণও নিজেদের আঙ্গিক ও দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্নভাবে যোগাযোগকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যোগাযোগ করা যায় বলে প্রক্রিয়াগত দৃষ্টিকোণ থেকেও যোগাযোগকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তাঁদের এসব প্রচেষ্টা যোগাযোগের ধারণাকে বহুলাংশেই সংজ্ঞাবদ্ধ করলেও জন্ম দিয়েছে অনেক বিভ্রান্তির।
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে যোগাযোগের সংজ্ঞা
জ্ঞান-বিজ্ঞানের আঁতুড়ঘর প্রাচীন গ্রিসের গবেষক-তাত্ত্বিকরাও যোগাযোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। দর্শন, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছিল সেই যুগের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। এসব বিবেচনায় প্লেটো, এরিস্টটলের মত দার্শনিকরা যোগাযোগকে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তখন যোগাযোগকে বলা হতো Rhetoric, যার অর্থ সাবলীল বক্তব্য, কার্যকরভাবে কিছু বলা বা লেখা, বক্তব্যের মাধ্যমে প্রভাবিত করার দক্ষতা।
প্রাচীন গ্রিকের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিন দার্শনিকের অন্যতম প্লেটো তাঁর গুরু সক্রেটিস এবং ফেড্রাসের মধ্যকার সংলাপের বর্ণনায় Phaedrus গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “Rhetoric is the art of ruling the minds of men”, অর্থাৎ মানুষের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণের শৈল্পিক দক্ষতাই যোগাযোগ।10উদ্ধৃতি: “Rhetoric is the art of ruling the minds of men”; গ্রন্থ: Phaedrus; লেখক: Plato;
তিনি ফলাফল বা ফলাবর্তন (Feedback)-কেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন, বলতে চেয়েছেন – কথাবার্তা নয়, বরং বার্তার মাধ্যমে মানুষ তথা গ্রাহককে প্রভাবিত করাই যোগাযোগ।
প্লেটোর অন্যতম শিষ্য দার্শনিক অ্যারিস্টটলও ফলাফলের দিকে গুরুত্বারোপ করে যোগাযোগের সংজ্ঞা দিয়েছেন। Rhetoric গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “Rhetoric is the search for all the available means of persuasion.” অর্থাৎ প্রভাবিত করার জন্য সুলভ সকল উপায়ের অনুসন্ধানই হচ্ছে যোগাযোগ।11উদ্ধৃতি: “Rhetoric is the search for all the available means of persuasion.”; গ্রন্থ: Rhetoric; লেখক: Aristotle;
এই সংজ্ঞাটি কিছুটা ব্যাপক। অ্যারিস্টটল ‘the search for all the available means’ শব্দগুচ্ছ দ্বারা বুঝিয়েছেন, কথন ও লিখন, ইশারা ও চিহ্ন, সাহিত্য ও শিল্প ইত্যাদি যেকোনো মাধ্যমেই যোগাযোগ হতে পারে। আধুনিক যুগের সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন, রেডিও ইত্যাদিকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আর Persuasion অর্থ দৃঢ় বিশ্বাস, প্রভাবন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকো-অ্যাকোস্টিক ল্যাবরেটরির প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডঃ স্টেনলি স্মিথ স্টিভেন্স (এস এস স্টিভেন্স) বলেছেন, উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী ইন্দ্রিয়ের প্রতি জীবসত্ত্বার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে যোগাযোগ।12 উদ্ধৃতি: “Communication is the discriminatory response of an organism to a stimulus.”; প্রবন্ধ: A Definition of Communication; লেখক: Dr. Stanley Smith Stevens (S. S. Stevens);
তাঁর এই সংজ্ঞা ‘Stimulus Response’ (SR) নামে পরিচিত। এখানে তিনি ‘জীবসত্ত্বার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিক্রিয়া (Discriminatory Response of an Organism)’ বলতে বুঝিয়েছেন, কোনো জীবন্ত প্রাণীর সুচিন্তিত বা সচেতন আচরণ। আর মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, Stimulus হচ্ছে এমন কিছু, যা শারীরিক বা আচরণগত পরিবর্তন ঘটায়।
সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যোগাযোগের সংজ্ঞা
সমাজ-সভ্যতার অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে যোগাযোগ। উন্নত যোগাযোগ কৌশলের কারণেই মানুষ সামাজিক জীব। প্রসঙ্গতই, সমাজবিজ্ঞানীরাও যোগাযোগকে তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
সমাজতত্ত্ববিদ চার্লস কুলি সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে যোগাযোগের ধারণায় লিখেছেন, “মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক যে ক্রিয়াকৌশলের মধ্য দিয়ে বজায় থাকে ও বিকশিত হয় তা-ই যোগাযোগ। অর্থাৎ মনের সকল প্রতীকচিহ্নগুলিকে এক জায়গা থেকে অন্যত্র আদান-প্রদান ও সময়ের আধারে থাকে চিরায়ত করে ধরে রাখাই যোগাযোগ।”13গ্রন্থ: Social Communication; লেখক: Charles H. Cooley; প্রকাশক: Charles Scribner’s Sons;
সমাজবিজ্ঞানী কেনেথ কে. সেরেনো এবং সি. ডেভিড মর্টেনসেন লিখেছেন, “নির্দিষ্ট একটি সামাজিক পরিমণ্ডলে বার্তার প্রেরক ও গ্রাহকের যেই মিথস্ক্রিয়া হয়, সেই প্রক্রিয়াই যোগাযোগ।” তাঁরা বার্তার আদান-প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা বা সমাজস্থ মানুষের মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়াকেই যোগাযোগ হিসেবে অভিহিত করেছেন।14উদ্ধৃতি: “Communication is a process by which senders and receivers of the messages interact in a given social context.”; গ্রন্থ: Foundations of Communication Theory; লেখক: Kenneth K. Sereno, C. David Mortensen;
সমাজবিজ্ঞানী ওয়াই. ভি. লক্ষ্মণ রাও এর মতে, “যোগাযোগ বলতে এমন এক সামাজিক প্রক্রিয়াকে বোঝায় – যা মানব সমাজে তথ্যের প্রবাহ ও ভাবাদর্শ ছড়িয়ে দেয় এবং চিন্তার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করে। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন তথ্য এবং চিন্তার প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে কোন ধারণা বা মতাদর্শ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে যোগাযোগ।”15উদ্ধৃতি: “Communication refers to a social process – the flow of information, the circulation of ideas in human society, and the propagation and internalization of thoughts.”; লেখক: Y. V. Lakshmana Rao;
অধ্যাপক জর্জ গার্বনারের ভাষ্যমতে, “যোগাযোগ হল পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা গঠনের লক্ষ্যে সামাজিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া।”16উদ্ধৃতি: “Communication is the process of sharing cultural values and beliefs, with the purpose of shaping our understanding of the world around us.”; লেখক: George Gerbner;
প্রক্রিয়াগত দৃষ্টিকোণ থেকে যোগাযোগ
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই যোগাযোগকে ‘প্রক্রিয়া’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁদের কারো মতে যোগাযোগ এক ধরনের সম্মোহনী বা প্রভাবক প্রক্রিয়া, কারো মতে এটি সম্পর্ক তৈরির প্রক্রিয়া।
যোগাযোগ অধ্যয়নের অন্যতম পথিকৃৎ উইলবার শ্র্যাম (Wilbur Schramm) যোগাযোগকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ১৯৫২ সালে How Communication Works প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “নির্দিষ্ট একটি বার্তার জন্য গ্রাহক এবং প্রেরককে একসাথে এক সুরে বাঁধাই যোগাযোগের সারকথা।”17উদ্ধৃতি: “The essence of communication is getting the receiver and the sender ‘tuned’ together for a particular message.”; প্রবন্ধ: How Communication Works; লেখক: Wilbur Schramm;
১৯৫৪ সালে University of Illinios Press থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘The Process & Effects of Mass Communication’ গ্রন্থে এই প্রবন্ধটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে বইটির পরিমার্জিত সংস্করণে তিনি এই প্রবন্ধটি বাদ দিয়ে ‘The Nature of Communication between Humans’ শিরোনামে আরেকটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করেন।
এপ্রবন্ধে তিনি যোগাযোগকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, “তথ্য আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের মাঝে যে সম্পর্ক – তাকেই আমরা যোগাযোগ বলি।”18উদ্ধৃতি: “The process of sharing information and the relationship of the participants in the process – we call communication.”; প্রবন্ধ: The Nature of Communication between Humans; লেখক: Wilbur Schramm;
কার্ল হোভল্যান্ড, যিনি একাধারে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানী, তাঁর ভাষ্যমতে, “যোগাযোগ এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একে অন্যের আচরণ পরিবর্তনের জন্য উদ্দীপক (সাধারণত বাচনিক সংকেত) পাঠায়।”19উদ্ধৃতি: “Communication is the process by which one individual (the communicator) transmits stimuli (usually verbal symbols) to modify the behavior of other individuals (communicates).”; প্রবন্ধ: Social Communication; লেখক: Carl Hovland;
লরেন্স কিনকেইড এর মতে, “যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী যখন নিজেদের এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে পারস্পরিক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে, সেই প্রক্রিয়াই হচ্ছে যোগাযোগ।”20উদ্ধৃতি: “Communication is a process by which two or more individuals or groups share information in order to reach a mutual understanding of each other and of the world which they live in.”; লেখক: Lawrence Kincaid;
অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকে যোগাযোগ
যোগাযোগের পরিধি এতটাই ব্যাপক যে একে নির্দিষ্ট কিছু দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করা যথেষ্ট নয়। যোগাযোগ কেবল মানবীয় যোগাযোগের মধ্যেই সীমিত নয়, অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও যোগাযোগ ঘটে। রেডিও সিগনালের মাধ্যমে যন্ত্র থেকে যন্ত্রেও যোগাযোগ হয়।
যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তির ভূমিকা প্রসঙ্গে মার্কিন গবেষক ইয়র্গেন রু’শ লিখেছেন, “যোগাযোগ এমন এক প্রক্রিয়া, যা বর্তমান পৃথিবীর অবিচ্ছিন্ন অংশগুলিকে পারস্পরিক সংযুক্ত রাখে।”21উদ্ধৃতি: “Communication is the process that links discontinuous parts of the living world to one another.”; প্রবন্ধ: Technology and Social Communication; লেখক: Jurgen Ruesch;
যুক্তরাষ্ট্রের পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক রাল্ফ এল ওয়েব যোগাযোগকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীর প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, “যোগাযোগ হল বার্তা পাঠানো ও গ্রহণের সেই প্রক্রিয়া, যার অনিবার্য পরিণতিতে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণী একে অপরের সংস্পর্শে আসে।”22উদ্ধৃতি: “Communication is the process of sending and receiving messages that inevitably results whenever human beings, or other animals, are exposed to each other.”; গ্রন্থ: Interpersonal speech communication: Principles and practices, লেখক: Ralph L. Webb;
প্রাণীবিদ হুবার্ট ফ্রিংসের মতে, “যখন কোন প্রাণী তার পরিমণ্ডলে রাসায়নিক বা পদার্থগত পরিবর্তন ঘটায়, (কোন সংকেতের মাধ্যমে অন্য কোন প্রাণীর আচরণকে প্রভাবিত করে), তখন প্রাণী দু’টির মাঝে যোগাযোগ হয়েছে বলা যায়।”23উদ্ধৃতি: “Communication between two animals is said to occur when one animal produces a chemical or physical change in the environment (signs that influence the behavior of another…”; গ্রন্থ: Animal Communication in Communication: Concepts and Perspectives; লেখক: Hubert Frings;
মনোবিজ্ঞানী স্ট্যানলি শ্যাক্টার “Deviation, Rejection, and Communication” প্রবন্ধে লিখেছেন, “যোগাযোগ এমন বিশেষ এক কৌশল, যার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করা হয়।”24উদ্ধৃতি: “Communication is the mechanism by which power is exerted”; প্রবন্ধ: Deviation, Rejection, and Communication, লেখক: Stanley Schachter;
প্রকৃতপক্ষে যোগাযোগকে পরিপূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করা দুঃসাধ্য। প্রেরক, গ্রাহক, বার্তার মত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে যোগাযোগের ধরণ, মাধ্যম, প্রক্রিয়াও ভিন্ন ভিন্ন। তাই, “যা বলা হয় নি, তা বুঝে নেয়াই যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।” বিখ্যাত লেখক ও ব্যবস্থাপনা পরামর্শক Peter Drucker-র এই উক্তিটিই প্রকৃতপক্ষে যোগাযোগের মূলতত্ত্ব। কে কাকে কি বলছে, তার চেয়ে বরং বুঝাতে এবং বুঝতে পারাই যোগাযোগ!
তথ্যসূত্র - References
- 1উদ্ধৃতি: “the process by which messages or information is sent from one place or person to another, or the message itself”; অভিধান: Cambridge Academic Content Dictionary; প্রকাশক: Cambridge University Press;
- 2উদ্ধৃতি: “Communication is also the exchange of information and the expression of feeling that can result in understanding”; অভিধান: Cambridge Academic Content Dictionary; প্রকাশক: Cambridge University Press;
- 3উদ্ধৃতি: “the activity or process of expressing ideas and feelings or of giving people information”; অভিধান: Oxford Advanced Learner’s Dictionary; প্রকাশক: Oxford University Press;
- 4উদ্ধৃতি: “a process by which information is exchanged between individuals through a common system of symbols, signs, or behavior”; অভিধান: Merriam-Webster.com; প্রকাশক: Merriam-Webster, Inc.;
- 5উদ্ধৃতি: “Communication represents and attempts to couple two organisms, to bridge the gap between two individuals’ thought, the production and reception of message which have meaning for both”; লেখক: David K. Berlo;
- 6উদ্ধৃতি: “Communication is defined as the process of using messages to generate meaning. Communication is considered a process because it is an activity, an exchange, or a set of behaviors – not an unchanging product.”; গ্রন্থ: Human Communication; লেখক: Judy C. Pearson, Paul E. Nelson, Scott Titsworth, Lynn Harter;
- 7উদ্ধৃতি: “We use the word ‘communication’ sometimes to refer to what is so transferred, sometimes to the means by which it is transferred, sometimes to the whole process. In many cases, what is transferred in this way continues to be shared; if I convey information to another person, it does not leave my own possession through coming into his. Accordingly, the word ‘communication’ acquires also the sense of participation.”; প্রবন্ধ: What is Communication?; লেখক: Alfred Jules Freddie Ayer;
- 8উদ্ধৃতি: “Communication is one of those human activities that everyone recognizes but few can define satisfactorily”; গ্রন্থ: Introduction to Communication Studies; লেখক: John Fiske;
- 9উদ্ধৃতি: “The meaning of the word ‘communication’ is at once both clear and obscure. It is clear enough in conventional usage, but obscure when we seek to determine the limits of its application”; প্রবন্ধ: On Defining Communication; লেখক: Thomas R Nilsen;
- 10উদ্ধৃতি: “Rhetoric is the art of ruling the minds of men”; গ্রন্থ: Phaedrus; লেখক: Plato;
- 11উদ্ধৃতি: “Rhetoric is the search for all the available means of persuasion.”; গ্রন্থ: Rhetoric; লেখক: Aristotle;
- 12উদ্ধৃতি: “Communication is the discriminatory response of an organism to a stimulus.”; প্রবন্ধ: A Definition of Communication; লেখক: Dr. Stanley Smith Stevens (S. S. Stevens);
- 13গ্রন্থ: Social Communication; লেখক: Charles H. Cooley; প্রকাশক: Charles Scribner’s Sons;
- 14উদ্ধৃতি: “Communication is a process by which senders and receivers of the messages interact in a given social context.”; গ্রন্থ: Foundations of Communication Theory; লেখক: Kenneth K. Sereno, C. David Mortensen;
- 15উদ্ধৃতি: “Communication refers to a social process – the flow of information, the circulation of ideas in human society, and the propagation and internalization of thoughts.”; লেখক: Y. V. Lakshmana Rao;
- 16উদ্ধৃতি: “Communication is the process of sharing cultural values and beliefs, with the purpose of shaping our understanding of the world around us.”; লেখক: George Gerbner;
- 17উদ্ধৃতি: “The essence of communication is getting the receiver and the sender ‘tuned’ together for a particular message.”; প্রবন্ধ: How Communication Works; লেখক: Wilbur Schramm;
- 18উদ্ধৃতি: “The process of sharing information and the relationship of the participants in the process – we call communication.”; প্রবন্ধ: The Nature of Communication between Humans; লেখক: Wilbur Schramm;
- 19উদ্ধৃতি: “Communication is the process by which one individual (the communicator) transmits stimuli (usually verbal symbols) to modify the behavior of other individuals (communicates).”; প্রবন্ধ: Social Communication; লেখক: Carl Hovland;
- 20উদ্ধৃতি: “Communication is a process by which two or more individuals or groups share information in order to reach a mutual understanding of each other and of the world which they live in.”; লেখক: Lawrence Kincaid;
- 21উদ্ধৃতি: “Communication is the process that links discontinuous parts of the living world to one another.”; প্রবন্ধ: Technology and Social Communication; লেখক: Jurgen Ruesch;
- 22উদ্ধৃতি: “Communication is the process of sending and receiving messages that inevitably results whenever human beings, or other animals, are exposed to each other.”; গ্রন্থ: Interpersonal speech communication: Principles and practices, লেখক: Ralph L. Webb;
- 23উদ্ধৃতি: “Communication between two animals is said to occur when one animal produces a chemical or physical change in the environment (signs that influence the behavior of another…”; গ্রন্থ: Animal Communication in Communication: Concepts and Perspectives; লেখক: Hubert Frings;
- 24উদ্ধৃতি: “Communication is the mechanism by which power is exerted”; প্রবন্ধ: Deviation, Rejection, and Communication, লেখক: Stanley Schachter;