বিশ্বায়নের এই যুগে নতুন উদ্ভাবিত যেকোনো ধারণা ও প্রযুক্তি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। আর্থসামাজিক কারণে অনুন্নত দেশ ও অঞ্চলগুলো উদ্ভাবনে পিছিয়ে থাকলেও সেখানকার মানুষজনও উন্নত বিশ্বের উদ্ভাবিত ধারণা ও প্রযুক্তি গ্রহণ ও প্রয়োগ করে থাকে। নতুন উদ্ভাবিত এসব জ্ঞান, ধারণা ও প্রযুক্তি কেন, কিভাবে এবং কি হারে উন্নত বিশ্ব থেকে তৃতীয় বিশ্বের গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে, তা ব্যাখ্যার একটি মাধ্যম হচ্ছে উদ্ভাবন প্রসারণ তত্ত্ব।
১৯ শতকের শেষদিকে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল সর্বপ্রথম এই তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন। ফ্রেডরিখ রেটজেল এবং লিও ফ্রোবেনিয়াস প্রমুখ জার্মান ও অস্ট্রিয়ান নৃবিজ্ঞানী এবং ভূগোলবিদগণও সেসময় তত্ত্বটি নিয়ে গবেষণা করেন।
১৯২০ থেকে ১৯৪০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকরা ব্যক্তি-উদ্যোগে হাইব্রিড বীজ, আধুনিক সরঞ্জাম এবং উন্নত কৌশল গ্রহণ করে এবং সেখানকার ফলন বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৩ সালে গবেষক রায়ান ব্রাইস এবং নিল গ্রস যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যের কৃষকদের মাঝে উচ্চফলনশীল ভুট্টা বীজ দ্বারা চাষাবাদের প্রবণতা নিয়ে “The diffusion of hybrid seed corn in two Iowa communities” শিরোনামে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন,1 নিবন্ধ: The Diffusion of Hybrid Seed Corn in Two Iowa Communities; লেখক: Bryce Ryan, Neal C. Gross; প্রকাশক: Rural Sociology; প্রকাশকাল: ১৯৪৩; যা ছিল উদ্ভাবন প্রসারন নিয়ে ব্যাপক গবেষণার সূচনাপর্ব।
১৯৬২ সালে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ এভারেট রজার্স “Diffusion of Innovations” গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্প এবং চিকিৎসা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় ৫৮০টি কেস অধ্যয়ন করে উদ্ভাবনের প্রসারণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করা হয়, যা পরবর্তীতে “উদ্ভাবন প্রসারণ তত্ত্ব” নামে পরিচিত পায়।
বর্তমানে সমাজবিজ্ঞান, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, উন্নয়ন যোগাযোগ ও অধ্যয়ন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও বিজ্ঞান, ব্যবসায় ও প্রচারণা, সংগঠন ও ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে গবেষণা এবং লক্ষ্য বাস্তবায়নে এই তত্ত্বের বহুল প্রয়োগ ঘটছে।
উদ্ভাবন প্রসারণ তত্ত্ব – Diffusion of Innovation Theory
অধ্যাপক ডঃ এভারেট এম রজার্স তাঁর “Diffusion of Innovations” গ্রন্থে লিখেছেনঃ “প্রসারণ (Diffusion) হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সমাজের সদস্যদেরকে ক্রমাগত সুনির্দিষ্ট কিছু উপায়ে একটি উদ্ভাবন সম্পর্কে অবগত করা হয়।”2উদ্ধৃতি: “Diffusion is the process by which an innovation is communicated through certain channels over time among the members of a social system.”; গ্রন্থ: Diffusion of Innovation; সংস্করণ: ১ম; লেখক: Everett M. Rogers; প্রকাশক: Free Press of Glencoe; প্রকাশকাল: ১৯৬২;
এই গ্রন্থে অধ্যাপক রজার্স প্রায়োগিক দিকগুলো উল্লেখ করার মাধ্যমে তত্ত্বটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন, একই সাথে উন্নয়ন যোগাযোগের ভিত দৃঢ় করেন। এতে তিনি যোগাযোগ ও সাংস্কৃতির মাধ্যমে অনুন্নত বিশ্বে পরিবর্তন আনতে গণমাধ্যমের ভূমিকা তুলে ধরেন। এছাড়াও, যেকোন নতুন উদ্ভাবনের প্রচার ও প্রসারে এবং গনমানুষকে সেই উদ্ভাবন এবং উন্নয়নের সুফল ভোগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের উপর নির্ভর করে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
উদ্ভাবন প্রসারণের উপাদান – Elements of Diffusion of Innovation
উদ্ভাবনের প্রসারণ বলতে সাধারণার্থে আমরা বুঝি নতুন তত্ত্ব, ধারণা বা বস্তুর প্রচার এবং প্রচারের ফলে সৃষ্ট চাহিদা ও ব্যবহারের প্রসার। অধ্যাপক রজার্সের “Diffusion of Innovations” গ্রন্থে উদ্ভাবন প্রসারণের কিছু মৌলিক উপাদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা –
উদ্ভাবন – Innovation
উদ্ভাবন হল নতুন কিছুর সৃষ্টি, যা সমস্যার সমাধান দেয় কিংবা সুবিধা তৈরি করে। উদ্ভাবন দৃশ্যমান বস্তু বা বিমূর্ত ধারণা – উভয় ধরণেরই হতে পারে। তবে, প্রসারণ বা প্রচারণার পূর্বশর্ত হচ্ছে উদ্ভাবন।
ধরুন, আপনি একজন প্রোগ্রামার এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রযুক্তিনির্ভর কিছু করতে চাচ্ছেন। এমন একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করলে কেমন হয়, যা বাড়ির বিভিন্ন অংশের ছবি দেখে ব্যবহারকারীকে সতর্কতামূলক বার্তা দিবে যে কোন কোন স্থানে ডেঙ্গু জ্বর সৃষ্টিকারী এডিস মশার জন্ম ও বংশবিস্তার হতে পারে?
এক্ষেত্রে, আপনাকে প্রথমেই পরিকল্পনা অনুযায়ী অ্যাপ্লিকেশনটি তৈরি বা উদ্ভাবন করতে হবে। অন্যথায়, প্রসারণের বিষয়বস্তুই থাকবে না।
যোগাযোগের মাধ্যম – Communication Channel
উদ্ভাবনের সফলতা নির্ভর করে কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো এবং তাদের দ্বারা গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ, উদ্ভাবনের পর বিষয় বা বস্তুটি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উপায় বা মাধ্যমে লক্ষিত জনগোষ্ঠীকে জানাতে হবে, যাতে তারা বিষয়টি সম্পর্কে জানে এবং ব্যবহার বা গ্রহণ করে। জানানোর ক্ষেত্রে যোগাযোগের মাধ্যম অত্যন্ত কৌশলীভাবে নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায়, কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
যেমন, আপনি যদি আপনার উদ্ভাবিত সেই অ্যাপ্লিকেশনটির প্রসারণে কাগজের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রচার করেন, তাহলে যারা পত্রিকা পড়ে না, তারা জানবেন না। আবার, কেবল বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দিলে ইন্টারনেট-বিমুখ বয়োবৃদ্ধরা জানবে না। আর কোথাওই বিজ্ঞাপন না দিলে কেউ জানবেও না কিংবা ব্যবহারও করবে না।
তাই, উদ্ভাবনের পর বিষয় বা বস্তুটি সম্পর্কে কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীকে তাদের মত করে, তাদের পরিচিত কোনো মাধ্যমে জানাতে হবে।
সময়সীমা – Time Frame
নতুন কিছু গ্রহণ করা একটি মানসিক প্রক্রিয়া। অধিকাংশক্ষেত্রেই এটি তৎক্ষণাৎ হয় না। নতুন কিছু জানা বা অবগত হওয়ার পর তা গ্রহণ করা পর্যন্ত প্রতিটি ব্যক্তির কিছু সময় লাগে। অধিকন্তু, গ্রহণের পর তা যথাযথভাবে ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
এজন্য উদ্ভাবন প্রসারণে দীর্ঘ সময়সীমা রাখা উচিত। যথাযথ মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগের পর তাৎক্ষনিক ফলাফল আশা না করে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের সাথে অব্যাহত যোগাযোগ রাখতে হবে।
যেমন, আপনার উদ্ভাবিত সেই অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিয়েও প্রথমদিকে আশানুরূপ ব্যবহারকারী হয়তো নাও পেতে পারেন। কিন্তু অল্প কিছু ব্যবহারকারী যখন অ্যাপ্লিকেশনটির কার্যকারিতা সম্পর্কে ভালো রিভিউ দিবে, তখন অন্যরাও অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহারে আগ্রহী হবে। আবার, গ্রীষ্মকালে হয়তো তেমন সাড়া পাবেন না কিন্তু বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলে কল্পনাতীত সাড়া পেতে পারেন।
সামাজিক কাঠামো ও সদস্য – Social System & Members
উদ্ভাবন প্রসারণে সামাজিক কাঠামো এবং সমাজের সদস্যবৃন্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভাবনের প্রসারণ এবং গ্রহণযোগ্যতা মূলত সামাজিক কাঠামোর উপর নির্ভরশীল। সামাজিক রীতিনীতি এবং পরিস্থিতির কারণে অনেক অভাবনীয় উদ্ভাবনও গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। আবার, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামাজিক কারণে সমাজের সদস্যগণ বিভিন্ন উদ্ভাবন গ্রহণ করে নেয়।
যেমন, শহরতলীর বস্তিগুলোর নিজস্ব সমাজ কাঠামো আছে, সেখানকার বাসিন্দাদের আপনার উদ্ভাবিত অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহার করার সক্ষমতাও আছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের প্রতাপে তারা চাইলেই আপনার অ্যাপ্লিকেশনের নির্দেশনা অনুসারে বস্তির অবকাঠামোগত পরিবর্তন করতে পারবে না। তাই তারা অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহারও করবে না।
পক্ষান্তরে, সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত শহরগুলোর বাসিন্দারা স্বেচ্ছায় কিংবা জরিমানার ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহার করতে পারে। এভাবেই সামাজিক কাঠামো এবং সমাজের সদস্য দ্বারা উদ্ভাবনের প্রসারণ প্রভাবিত হয়।
উদ্ভাবন গ্রহণ প্রক্রিয়া – Innovation Adoption Process
একটি উদ্ভাবন তখনই স্বার্থক হয়, জনসাধারণ তা গ্রহণ করে নেয়। কিন্তু উদ্ভাবন গ্রহণ একটি জটিল মানসিক প্রক্রিয়া। একজন ব্যক্তি একটি উদ্ভাবন গ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে কতগুলো মানসিক স্তর অতিক্রম করে।
অধ্যাঃ রজার্স প্রায় ৫৮০-টি কেস অধ্যয়নের সারমর্ম থেকে উদ্ভাবন গ্রহণ প্রক্রিয়ার পাঁচটি স্তর চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হচ্ছে –
সচেতনতা – Awareness
উদ্ভাবনকারী যখন সর্বপ্রথম তার উদ্ভাবন জনসম্মুখে প্রকাশ করে কিংবা লক্ষিত জনগোষ্ঠীকে উদ্ভাবন সম্পর্কে জানায়, সেই স্তরকে বলা হয় সচেতনতা। এই স্তরে সমাজের সদস্য বা মানুষজন কোন উদ্ভাবনের কথা প্রথমবারের শুনতে বা জানতে পারে মাত্র।
পরিপূর্ণ তথ্য জানা থাকে না বলে লক্ষিত জনগোষ্ঠী এই স্তরে উদ্ভাবন সম্পর্কে আরও জানতে তেমন আগ্রহ দেখায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সচেতনতা কোন নিষ্ক্রিয় ব্যাপার নয়। ক্রমাগত সচেতনতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালালে সমাজের সদস্যরা ঐ উদ্ভাবন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
আগ্রহ – Interest
সচেতন বা ইতোমধ্যে অবগত ব্যক্তিদেরকে এই স্তরে উদ্ভাবন সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে আগ্রহী করে তোলা হয়। ফলশ্রুতিতে, তারা উদ্ভাবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করে।
অতীত কিংবা বর্তমান কোনো অভিজ্ঞতা বা প্রয়োজনীয়তার সম্পূরক হলে উদ্ভাবনের গ্রহণযোগ্যতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। লক্ষিত জনগোষ্ঠী তখন তাদের প্রাত্যহিক জীবনে সেই উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবতে শুরু করে।
মূল্যায়ন বা বিবেচনা – Evaluation or Consideration
এই স্তরে আগ্রহী জনগোষ্ঠী উদ্ভাবনটি কাল্পনিকভাবে ব্যবহার বা প্রয়োগ করে এবং এর ভালো-মন্দ দিক গুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেন। এই মূল্যায়নে প্রয়োজনীয় বা লাভজনক হলে তারা উদ্ভাবনটি সরাসরি যাচাই-বাছাই করে দেখতে চায়। যদি তারা উদ্ভাবনটি অপ্রয়োজনীয় বা কল্যাণকর নয় বলে বিবেচনা করে, তবে তা প্রত্যাখ্যান করে।
যাচাই বা পরীক্ষা – Trial or Test
কাল্পনিক ব্যবহার এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে আগ্রহী জনগোষ্ঠীর যে অংশ উদ্ভাবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেছে, এই স্তরে তারা উদ্ভাবনটি বাস্তবে যাচাই বা পরীক্ষা করে দেখবে।
এক্ষেত্রে, ব্যক্তিরা বাস্তব প্রায়োগিকতার পাশাপাশি এর নেতিবাচক দিক কিংবা বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলোও বিবেচনায় নিয়ে থাকে। অনেকে যাচাইয়ের জন্য উদ্ভাবনটি আংশিকভাবে গ্রহণও করে থাকেন। অতঃপর, চূড়ান্তভাবে গ্রহণ বা বর্জনের সিধান্ত নেন।
এই স্তরে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত যদি হ্যাঁ সূচক হয় তবে তিনি তা পরীক্ষামূলকভাবে গ্রহণ করেন। আমরা খাবার পিলের কথাই বলি। কোন মহিলা পিল খাওয়ার জন্য সম্মত হলে তিনি প্রথম কয়েক মাস খেয়ে পরীক্ষা করে দেখেন যে এটার কোন অন্যান্য উপসর্গ আছে কিনা, যেমন- মাথা ঘুরাচ্ছে কিনা দুর্বল বোধ করছেন কিনা বা কার্যকারিতা ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি।
এই স্তরকে পরীক্ষণের স্তর বলা হয়। যে উদ্ভাবনটি যত সীমাবদ্ধভাবে বা আংশিকভাবে ব্যবহার করা যায় তত এর গ্রহণযোগ্যতা বেশি হবে।
গ্রহণ – Adoption
সকল দিক বিবেচনা এবং পরীক্ষা শেষে এই স্তরে লক্ষিত জনগোষ্ঠী উদ্ভাবনটি গ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে উদ্ভাবন সম্পর্কে অবগতদের তুলনায় গ্রহণকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক কমে আসে।
উদ্ভাবন সম্পর্কে যত বেশি মানুষকে সচেতন করা যাবে, এর গ্রহণযোগ্যতা তত বেশি হবে। রজার্সের মতে, এই স্তরটি সবচেয়ে জটিল মানসিক স্তর। তাই, উদ্ভবনটি সহজ হলে এটি দ্রুত গ্রহণযোগ্য হবে; জটিল হলে এর গ্রহণযোগ্যতা ধীরে ঘটবে।
উদ্ভাবন গ্রহণ ও বর্জন – Innovation Adoption & Rejection
উদ্ভাবন প্রসারণে গ্রহণ এবং বর্জন মুখ্য একটি বিষয়। সামাজিক কাঠামোর পাশাপাশি আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের দ্বারা উদ্ভাবন গ্রহণ কিংবা বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়। যেমনঃ
সুবিধা ও অসুবিধা – Advantages and Disadvantages
উদ্ভাবনটির ব্যবহার কতটা সুবিধাজনক অথবা এর ব্যবহারে কোনো অসুবিধা আছে কিনা, এসবের উপর উদ্ভাবন গ্রহণ কিংবা বর্জনের সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল।
উদাহরনস্বরূপ, আপনার উদ্ভাবিত সেই অ্যাপ্লিকেশনটি যদি সাধারণ মানের স্মার্টফোনে ব্যবহার করা যায়, তাহলে যেকোনো ব্যবহারকারীই তা গ্রহণ করবে। কিন্তু সেটি ব্যবহার করতে যদি উচ্চমূল্যের স্মার্টফোনের প্রয়োজন হয়, অসংখ্য আগ্রহী ব্যক্তি একারণে ব্যবহার করবে না।
উপযোগিতা ও অনুপযোগিতা – Utility and disutility
একটি সমাজ বা স্থানে উদ্ভাবনটির উপযোগিতা ও অনুপযোগিতাও উদ্ভাবন গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে এমন একটি অ্যাপ্লিকেশন উদ্ভাবনের যথেষ্ট উপযোগিতা থাকলেও যেসব উন্নত শহর বা দেশে ডেঙ্গু জ্বর বা এডিস মশার প্রকোপ প্রকোপ নেই, সেখানে এই অ্যাপ্লিকেশনের কোনো উপযোগিতাও নেই।
সরলতা ও জটিলতা – Simplicity or Complexity
উদ্ভাবনটি ব্যবহার সহজ নাকি জটিল, তার উপরও এর গ্রহণ বা বর্জন নির্ভর করে। ঐঅ্যাপ্লিকেশনটি যদি কেবল ডাওনলোড করে সহজেই ব্যবহার করা যায়, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সেটি ব্যবহার করতে যদি একাউন্ট খুলে কাগজপত্র দিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করে তারপর ব্যবহার করার মত জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়, সেক্ষেত্রে অধিকাংশ লোকই তা বর্জন করবে।
পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ যোগ্যতা – Testability & Observability
উদ্ভাবন বা নতুন কিছুই তৎক্ষণাৎ কেউ গ্রহণ করে ফেলে না। আগ্রহবোধ হলে মানুষ প্রথমে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিংবা অন্য যারা ব্যবহার করছে, তাদের পর্যবেক্ষণ করে। তারপর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, এসবের সুযোগ না থাকলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়।
তেমনি, আপনার উদ্ভাবিত সেই অ্যাপ্লিকেশনটি যদি প্রথমে বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়, তাহলে পরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এর উপকারিতা জেনে মানুষ তা গ্রহণ করে নিবে। কিন্তু, পরীক্ষণের সুযোগ না থাকলে বা কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারলে মানুষ তা বর্জন করবে।
উদ্ভাবন গ্রহণকারী ও বর্জনকারী – Innovation Adopter & Rejector
উদ্ভাবনের বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি সমাজের সদস্যদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা, শ্রেণি বা মর্যাদা ইত্যাদিও উদ্ভাবন গ্রহণ কিংবা বর্জনকে প্রভাবিত করে। বৈচিত্র্য ও স্বতন্ত্রবোধের কারণে জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ সহজেই যেকোনো উদ্ভাবন গ্রহণ করে, কিছু অংশ সেসব বর্জন করে, আবার কিছু অংশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে।
কালের পরিক্রমায় সমাজের প্রায় সকলেই একসময় সেসব উদ্ভাবন গ্রহণ বা বর্জন করে। তবে উদ্ভাবন প্রসারণের এই প্রক্রিয়াটি সরাসরি সকল জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যায় না। বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পরিশেষে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছায়। একে বহুস্তর জ্ঞাপন প্রবাহ তত্ত্ব (Multi Step Flow of Communication Theory) বলে।
অধ্যাঃ রজার্স উদ্ভাবন গ্রহণকারীদের পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেন। তারা হচ্ছেন –
উদ্ভাবক – Innovators
সর্বপ্রথম স্তরে স্বল্পসংখ্যক উদ্ভাবকগণ থাকেন, যারা মূলত উদ্ভাবন করেন এবং তা গ্রহণ করে থাকেন। এদের সংখ্যা সমগ্র জনগোষ্ঠীর মাত্র ২.৫%-র মত হয়ে থাকে।
অগ্রগামী গ্রহণকারী – Early Adopters
উদ্ভাবকদের থেকে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ তথা শাসকগোষ্ঠী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ধর্মগুরু প্রমুখ উদ্ভাবন সম্পর্কে জানেন। এদের মতমোড়ল (Opinion Leaders)-ও বলা হয়। জনগোষ্ঠীর এই অংশ উদ্ভাবন গ্রহণের পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। সমাজের প্রায় ১৩.৫% সদস্য এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
অগ্রগামী সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী – Early Majority
সমাজের শিক্ষিত, ধন্যাঢ্য এবং ব্যবসায়ী শ্রেণির ব্যক্তিরা মতমোড়লদের সংস্পর্শে উদ্ভাবন সম্পর্কিত নানান তথ্য জানতে পারেন এবং তাদের অনুসরণে সেসব গ্রহণ করে নেন। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তথা ৩৪% হওয়ায় এদের ‘প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ’-ও বলা হয়।
দ্বিধান্বিত সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী – Late Majority
সমাজের স্বল্পশিক্ষিত কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন নানান দ্বিধাদ্বন্দ্বে তৎক্ষণাৎ কোনো উদ্ভাবন গ্রহণ করেন না। তারা প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠদের পর্যবেক্ষণে রাখেন এবং সেই শ্রেণি উদ্ভাবন গ্রহণ করে লাভবান হলে তারা তা গ্রহণ করেন। সমাজে এদের সংখ্যাও ৩৪ শতাংশ। তাই, এদের বলা হয় ‘বিলম্বিত সংখ্যাগরিষ্ঠ’।
অনুন্নত জনগোষ্ঠী – Laggards
বহুস্তর জ্ঞাপন প্রবাহের সর্বশেষ স্তরে থাকে আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। অর্থনৈতিক টানাপোড়নের দরুন তারা খুবই হিসাবি হয়ে থাকেন এবং সহজে উদ্ভাবন গ্রহণ করতে পারেন না। একান্ত প্রয়োজনে উদ্ভাবন গ্রহণ করলেও বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখে অগ্র-প্রশ্চাত বিবেচনা করে তবেই তা গ্রহণ করেন। সমাজের প্রায় ১৬% সদস্য এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
কট্টরপন্থী জনগোষ্ঠী – Die Hards
উল্লেখিত পাঁচটি শ্রেণি বা স্তরের প্রতিটিতেই আবার দলছুট কিছু মানুষ থাকে, যারা কোনো উদ্ভাবনই গ্রহণ করতে চায় না। উদ্ভাবন গ্রহণে সকল ধরণের চেষ্টা ও প্রচারণাই তাদের মনোভাব বদলাতে ব্যর্থ হয়। তারা কোনো কিছুতেই প্রভাবিত হয় না। তাই এদেরকে কট্টর বলা হয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, পল ল্যাজার্সফিল্ড ও বার্নার্ড ব্যারেলসন প্রমুখের মতে, উদ্ভাবন প্রসারণ দু’টি স্তরে হয়ে থাকে। প্রথমত, উদ্ভাবনের তথ্য ও সংবাদ গণমাধ্যমে মতমোড়ল বা প্রভাবশালীদের কাছে পৌঁছায়। পরবর্তীতে, মতমোড়ল বা প্রভাবশালীরাই তা সাধারণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেন। একে দ্বিস্তর জ্ঞাপন প্রবাহ তত্ত্ব (Two Step Flow of Communication Theory) বলে।
উদ্ভাবন প্রসারণে গণমাধ্যম – Mass Media in Diffusion of Innovation
বর্তমান সময়ে প্রচার-প্রসারের সবচেয়ে কার্যকারী মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে সহজেই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো যায়। উদ্ভাবন প্রসারণেও গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
যেকোনো উদ্ভাবন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তা গ্রহণে জনসাধারণকে আগ্রহী করে তুলতে গণমাধ্যমগুলো বিভিন্ন সংবাদ এবং অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। এছাড়াও, দূরদেশের কোনো উদ্ভাবন চাইলেও একজন ব্যক্তির পক্ষে মূল্যায়ন বা পরীক্ষণ করা সম্ভবপর না হলেও গণমাধ্যমগুলো তা করতে পারে। অধিকন্তু, গণমাধ্যমে উদ্ভাবক এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত সংযুক্ত করায় উদ্ভাবন গ্রহণে সাধারণ মানুষ অধিক আগ্রহী হয়।
উদ্ভাবন প্রসারণ তত্ত্বের দুর্বলতা – Invalidity of Diffusion of Innovation
১.রজার্সের উদ্ভাবন ও বিকিরণ তত্ত্বটি মূলত স্বাস্থ্য ও কৃষি বিষয়ক উদ্ভাবনকে পরিপূর্ণভাবে প্রসারণের কৌশল তুলে ধরে। কিন্তু প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলি প্রতিযোগিতামূলক। আজকে একটি জিনিস উদ্ভাবন হলে কাল আরেকটি। এক্ষেত্রে উদ্ভাবন গ্রহণ রজার্সের তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্য নয়।
২. রজার্সের ডিফিউশন অব ইনোভিশন তত্ত্ব একমুখী যোগাযোগ প্রবাহকে নির্দেশ করে। এখানে উদ্ভাবকের সাথে গ্রাহকের কোনরকম আলাপ সম্ভব নয়। তাই উদ্ভাবন গ্রহণ স্লথ গতিতে চলতে থাকে এবং একটা সময় গ্রহণের মাত্রাটা থেমে যায়।
৩. সমাজের মতমোড়লরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য সামাজিক বৈশিষ্ট্যের সাথে অসামঞ্জস্য বা ভিন্ন সংস্কৃতির কোন উদ্ভাবন সমাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারেন। এতে সমাজের অধিকাংশ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা তাদের মূল্যবোধের উপর আঘাত হানতে পারে।
৪. এই গবেষণায় যে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছিল তা যথাপযুক্ত এবং নির্ভরযোগ্য ছিল না।
৫. এই তত্ত্বে ধরে নেওয়া হয়েছিল বিজ্ঞানীরাই উদ্ভাবন তৈরি করেন এবং তারাই একমাত্র যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী। এখানে কৃষকের অভিজ্ঞতা সমন্ধিত জ্ঞানকে সনাতন ভেবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
বিভিন্ন বিষয়ে উদ্ভাবন প্রসারণ তত্ত্বের প্রয়োগ সম্পর্কিত এপর্যন্ত প্রায় চার হাজারেরও অধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তবে, এগুলোর অধিকাংশই মূলত অধ্যাপক ডঃ এভারেট রজার্সের “Diffusion of Innovations” গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর মতামত হুবহু অনুসরণেই প্রকাশিত।
ফলে, দীর্ঘ সময়েও এই তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিমার্জন হয়নি। সকল ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির আগ্রাসী প্রভাবে তাই একসময়ের বহুল ব্যবহৃত ‘উদ্ভাবন প্রসারণ তত্ত্ব’ ক্রমেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ছে।
তথ্যসূত্র - References
- 1নিবন্ধ: The Diffusion of Hybrid Seed Corn in Two Iowa Communities; লেখক: Bryce Ryan, Neal C. Gross; প্রকাশক: Rural Sociology; প্রকাশকাল: ১৯৪৩;
- 2উদ্ধৃতি: “Diffusion is the process by which an innovation is communicated through certain channels over time among the members of a social system.”; গ্রন্থ: Diffusion of Innovation; সংস্করণ: ১ম; লেখক: Everett M. Rogers; প্রকাশক: Free Press of Glencoe; প্রকাশকাল: ১৯৬২;