ফ্যাক্ট চেক বা সত্যতা যাচাই সাংবাদিকতার মৌলিক একটি অংশ। সম্প্রতি ফ্যাক্ট চেকের কার্যক্রম নতুন মাত্রা পেলেও মূলত এটি বেশ পুরোনো একটি ধারণা। পেশাদার সাংবাদিকতার জন্মলগ্ন থেকেই সাংবাদিকরা তথ্য বা ঘটনার সত্যতা যাচাই করে তা সংবাদে রূপান্তরিত করে আসছে। অভিজ্ঞ সম্পাদকরা সেসব তথ্য বা সংবাদ পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সংশোধনের পর প্রকাশ করছে।
তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাংবাদিকতা ও তথ্য-প্রবাহের মাধ্যম ও ধরণে আমূল পরিবর্তন এসেছে। একদিকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সংবাদমাধ্যম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করছে, অপরদিকে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অসম্পাদিত ও অসঙ্গতিপূর্ণ অনেক তথ্য বা সংবাদ গনমানুষের কাছে মুহূর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে।
বিভিন্ন উপকথা, অনুমানগত ধারণা এবং ব্যাঙ্গাত্মক কৌতুককেও অনেকে সত্য ঘটনা বলে বিশ্বাস এবং প্রচার করে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-এর এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা তথ্য বা গুজব ছয় গুণ বেশি দ্রুত ছড়ায়।1গবেষণাপত্র: The spread of true and false news online; লেখক: Soroush Vosoughi, Deb Roy, Sinan Aral; প্রকাশক: MIT Initiative On The Digital Economy, Science (American Association for the Advancement of Science); প্রকাশকাল: মার্চ ২০১৮;
তথ্যের এই অবাধ প্রবাহ মুক্ত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সহায়ক হলেও বস্তুনিষ্ঠতা এবং যথার্থতা বর্জিত এধরণের সংবাদ জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এসবের প্রতিকারেই বর্তমানে মূলধারার গণমাধ্যম এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান “ফ্যাক্ট চেক”-র প্রতি গুরুত্তারোপ করছে।
ফ্যাক্ট চেক – Fact Check
প্রাথমিকভাবে ‘Fact’ অর্থ – সত্য, তথ্য, প্রকৃত ঘটনা এবং ‘Check’ অর্থ – পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই ইত্যাদি। সেই বিবেচনায়, ‘Fact Check’ অর্থ দাঁড়াচ্ছে – সত্যতা যাচাই, তথ্য পরীক্ষণ ইত্যাদি। অর্থাৎ, ঘটনা, সংবাদ বা তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়াই হচ্ছে ‘Fact Check’। একে ‘সত্যতা যাচাই’, ‘Fact-Check’, ‘Fact-Checking’ ইত্যাদিও বলা হয়ে থাকে।
ম্যারিয়াম-ওয়েবস্টার অভিধান মতে, ‘Fact Check’ হচ্ছে ঘটনা বা সংবাদের “প্রকৃত সত্যতা বা যথার্থতা যাচাই করা।”2উদ্ধৃতি: “to verify the factual accuracy”; অভিধান: Merriam-Webster.com; প্রকাশনী: Merriam-Webster, Inc.;
ক্যামব্রিজ অভিধান অনুসারে, ‘Fact Check’ হল “একটি লেখা, সংবাদ প্রতিবেদন, বক্তৃতা প্রভৃতির প্রতিটি তথ্য সঠিক কি না, তা যাচাই করা।”3উদ্ধৃতি: “to check that all the facts in a piece of writing, a news article, a speech, etc. are correct”; অভিধান: Cambridge Advanced Learner’s Dictionary & Thesaurus; প্রকাশক: Cambridge University Press;
লুকাস গ্রেভস এবং মিশেল এ. অ্যামাজিন তাঁদের “Fact-Checking as Idea and Practice in Journalism” গবেষণাপত্রের সারাংশে লিখেছেন, “সাংবাদিকতায় ফ্যাক্ট চেকের ঐতিহ্যগত তাৎপর্য রয়েছে, যা (সংবাদ) প্রকাশের পূর্বে অভ্যন্তরীণভাবে সেগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের সাথে সম্পর্কিত। সম্প্রতি রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক বা অন্যান্য পরিচিত ব্যক্তিদের বক্তব্যের সত্যতা প্রকাশ্য-জনসম্মুখে মূল্যায়নকৃত বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনকেও বোঝায়।… ব্যাপকার্থে এই পরিভাষা দ্বারা বোঝানো হয়, যাচাই-বাছাইয়ের প্রাত্যহিক কর্মপদ্ধতি এবং পেশাদার মনোভাবের সাথে সত্যতা যাচাই করা।… ফ্যাক্ট চেক হচ্ছে রাজনৈতিক দাবি, সংবাদ প্রতিবেদন বা অন্যান্য উন্মুক্ত প্রকাশনাগুলোর যথার্থতার প্রমাণ-ভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রকাশ করা।”4উদ্ধৃতি: “Fact-checking has a traditional meaning in journalism that relates to internal procedures for verifying facts prior to publication, as well as a newer sense denoting stories that publicly evaluate the truth of statements from politicians, journalists, or other public figures….the term also refers more broadly to verification routines and the professional concern with factual accuracy….fact-checking consists of publishing an evidence-based analysis of the accuracy of a political claim, news report, or other public text.”; গবেষণাপত্র: Fact-Checking as Idea and Practice in Journalism; লেখক: Lucas Graves, Michelle A. Amazeen; প্রকাশক: Oxford Research Encyclopedia of Communication; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯;
বাংলাদেশে এএফপি ফ্যাক্ট চেক-র সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশিরের বর্ণনায়, “‘সত্য খবর’ থেকে ‘ভুয়া খবর’ বা ‘ফেইক নিউজ’কে আলাদা করে চিনার পদ্ধতিকে বলে ‘ফ্যাক্ট চেকিং’। আপনি ফেসবুকে একটি পোস্টে দেখলেন বা ইউটিউব ভিডিওতে শুনলেন কিংবা আড্ডার সময় এক বন্ধু বলল, ‘রাতের আঁধারে বাঁশঝাড় থেকে সংগৃহীত পানি পান করলে করোনাভাইরাস হবে না’। এটি কি আসলেই ‘খবর’ নাকি ‘ভুয়া খবর’, তা খুঁজে বের করা হবে যে উপায়ে, সেটাকেই বলে ‘ফ্যাক্ট চেকিং’।”5গ্রন্থ: ফ্যাক্ট চেকিং ও ভেরিফিকেশন হ্যান্ডবুক; লেখক: কদরুদ্দিন শিশির; প্রকাশক: ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই); প্রকাশকাল: এপ্রিল, ২০২২;
উপরিউক্ত উদ্ধৃতিগুলো পর্যালোচনা করে বলা যায়, ‘Fact Check’ বা ‘সত্যতা যাচাই’ হচ্ছে প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ঘটনা এবং প্রচলিত গল্প-কথার প্রকৃত সত্যতা সূক্ষ্মভাবে যাচাই করা। গণমাধ্যম ও ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো যাচাই প্রক্রিয়া শেষে তুলনামূলক এবং বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে থাকে।
ফ্যাক্ট চেকের ক্ষেত্রসমূহ – Fields of Fact Check
আমরা আমাদের প্রত্যাহিক জীবনে ব্যক্তিগত, পেশাগত, শিক্ষাগত এবং অসংখ্য কারণে পারস্পারিক তথ্য আদান-প্রদান করে থাকি। তথ্য আদান-প্রদানের এই প্রক্রিয়াই ফ্যাক্ট চেকের প্রারম্ভিক ক্ষেত্র। তথ্যদাতার তথ্যটি সঠিক, যথার্থ বা সত্য কি না, তথ্য-গ্রাহকের উচিত তা যাচাই করে দেখা। অন্যথায়, ভুল তথ্যের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে পারে।
তবে, প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্ট চেকের প্রধানতম ক্ষেত্র হচ্ছে গণমাধ্যম এবং গণযোগাযোগ। বর্তমানে তথ্য আদান-প্রদান এবং সংবাদ প্রচার – সকল কিছুই ইন্টারনেট নির্ভর। এতে তথ্য প্রবাহ ব্যাপক গতিশীলতা পেলেও সম্পাদনা এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবে প্রচুর ভুল তথ্য ও সংবাদ ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এধরণের তথ্যের ছড়াছড়ি জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সেই বিবেচনায় তথ্যের নিন্মোক্ত ধরণগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্ট চেকের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যথা –
ভুল তথ্য – Misinformation
প্রথাগত ধারণা এবং লোক-মুখে শোনা কথা থেকে মূলত ‘ভুল তথ্য’-র উদ্ভব ঘটে এবং ব্যতিক্রম বা অভিনবত্বের প্রতি মানুষের ঝোঁকের কারণে তা ছড়িয়েও পড়ে। যেমন – “আনারস ও দুধ একসাথে খেলে মানুষ মারা যায়”, তথ্যটি ভুল। কিন্তু, বহু যুগ ধরেই অসংখ্য মানুষ তথ্যটি বিশ্বাস করে আসছে এবং প্রচারও করছে। আবেগবশত এমন ভুল তথ্য প্রচার করা হলেও এতে সাধারণত প্রচারকারীর অসৎ উদ্দেশ্য থাকে না।
এধরণের তথ্য প্রচারকারী জেনেবুঝে ছড়াচ্ছেন নাকি নিজের অজান্তে ছড়াচ্ছেন, ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে তা নিশ্চিতভাবে উদ্ঘাটনও সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে, ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনে ভুল তথ্য চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি সত্য তথ্যটি তুলে ধরা হয়।
কুতথ্য – Disinformation
মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে ভুল তথ্য ছড়ানো হলে তা ‘কুতথ্য’। অর্থাৎ, তথ্যদাতা যখন জানা সত্ত্বেও একটি ভুল তথ্য প্রচার করে, সেটি ‘কুতথ্য’ বলে গণ্য হয়। যেমন – এখন প্রায় সকলেই অবগত যে, “আনারস ও দুধ একসাথে খেলে মানুষ মারা যায়”, তথ্যটি ভুল। অবগত হওয়ার পরও যদি কেউ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তথ্যটি প্রচার করে, তাহলে সে ‘কুতথ্য’ প্রচার করছে।
তবে, কুতথ্য প্রচারণাকারী থেকে শুনে সেই তথ্যটি কেউ না জেনে, না বুঝে প্রচার করলে দ্বিতীয় ব্যক্তির দ্বারা ছড়ানো তথ্যটি হবে ‘ভুল তথ্য’, ‘কুতথ্য’ নয়। আবার, প্রথমে কেউ হয়তো একটু ভুল তথ্য প্রচার করেছেন এবং পরবর্তীতে কেউ তথ্যটি যে ভুল, তা জেনেও ছড়ালে সেটি হবে ‘কুতথ্য’, ‘ভুল তথ্য’ নয়।
অপতথ্য – Malinformation
কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে সঠিক তথ্যকেই বিকৃত বা ভিন্নার্থবোধকভাবে প্রচার করা হলে, তা হবে ‘অপতথ্য’। অর্থাৎ, তথ্যটি সত্য কিন্তু তা এমনভাবে প্রচার করা হলো, যা প্রকৃত অর্থের পরিবর্তে বিকৃত একটি অর্থ প্রদান করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করে।
যেমন – ছড়ানো হলো যে “আনারস-দুধ খেয়ে এক আসামির মৃত্যু”। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সেই আসামি মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা হিসেবে আনারস এবং দুধ খেতে চেয়েছিল এবং তার ইচ্ছা পূরণের পর দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। এক্ষেত্রে, আনারস ও দুধ খাওয়ার পর সেই আসামির মৃত্যু হলেও সেটি তার মৃত্যুর কারণ নয়, মূলত ফাঁসি দেয়ার কারণেই তার মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু, জেল কর্তৃপক্ষকে বিব্রত করতে অপতথ্য প্রচারকারী বিকৃতভাবে তথ্যটি ছড়িয়েছেন।
গুজব – Rumor
‘গুজব’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে – রটনা, জনরব, মুখে মুখে রটে যাওয়া কথা ইত্যাদি। প্রচলিত অর্থে ‘গুজব’ মানে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বা বানোয়াট তথ্য ছড়ানো হলেও ‘ফ্যাক্ট চেক’-র ক্ষেত্রে ‘গুজব’ হচ্ছে এমন ঘটনা বা তথ্য, যার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের আগেই লোক-মুখে ব্যাপকভাবে রটে গিয়েছে।
ইন্টারনেট, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যবহারকারীরা নির্বিচারে যেকোনো তথ্য প্রচার করতে বলে বর্তমানে অধিকাংশ গুজবের উৎপত্তিস্থল ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি। স্বার্থান্বেষী মহল প্রায়ই আকর্ষণীয় শিরোনাম বা থাম্বনেইল দিয়ে প্রথমে ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার করে এবং অন্যান্য ব্যবহারকারীরাও অন্ধবিশ্বাসে সেটি গণহারে প্রচার করে মুহূর্তেই সবখানে রটিয়ে দেয়। ফলে, সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের পূর্বেই তথ্যটি ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
অপপ্রচার – Propaganda
‘অপপ্রচার’ বা ‘প্রোপাগান্ডা’ হচ্ছে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক বা আদর্শিক উদ্দেশ্য, স্বার্থ কিংবা প্রভাব অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড। ‘প্রোপাগান্ডা’ শব্দটি সাধারণত নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হলেও এটি ইতিবাচক-ও হতে পারে।
অর্থাৎ, প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রচার করা হলে তা ‘প্রোপাগান্ডা’। এক্ষেত্রে, সেই তথ্যটি সত্য-ও হতে পারে, মিথ্যা-ও হতে পারে, ভুল তথ্য, কুতথ্য, অপতথ্য ও গুজবের সমন্বয়-ও হতে পারে কিংবা আংশিক সত্য এবং আংশিক মিথ্যার মিশেল-ও হতে পারে। এধরণের প্রচারণার উদ্দেশ্যও ভালো বা খারাপ কিংবা উভয়ই হতে পারে।
ভুয়া সংবাদ – Fake News
ভুয়া সংবাদ বলতে মূলত বোঝানো হয়, ভুল তথ্যের ভিত্তিতে প্রচারিত সংবাদ কিংবা বানোয়াট বা ভিত্তিহীন সংবাদ। প্রকৃতপক্ষে যেসব ঘটনা কখনো ঘটেনি কিংবা ঘটলেও সংবাদে প্রচারিত রূপে ঘটেনি, সেগুলোই ভুয়া সংবাদ।
অর্থাৎ, যেসব সংবাদের তথ্যের সত্যতা থাকে না কিংবা মনগড়া তথ্য দিয়ে সংবাদ সাজানো হয়, সেগুলো ভুয়া সংবাদ। সাধারণত, ভুল তথ্য এবং কুতথ্য থেকে এধরণের সংবাদের উৎপত্তি হয়। তাছাড়া, নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টালগুলো পাঠকদের আকৃষ্ট করতে এবং পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যমগুলো অপতথ্য, গুজব এবং অপপ্রচারকে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেও এধরণের সংবাদ উপস্থাপন করে।
বর্তমানে বেশিরভাগ ভুল তথ্য ও ভুয়া সংবাদ বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় ওয়েবসাইট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়। এছাড়াও, মৌখিক এবং লিখিতভাবেও ভুল তথ্য ও ভুয়া সংবাদ ছড়াতে পারে। প্রচারের এসব মাধ্যমকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে উপরিউক্ত ক্ষেত্রসমূহে ফ্যাক্ট চেক করা যেতে পারে।
ফ্যাক্ট চেকের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব – Purpose & Importance of Fact Check
ফ্যাক্ট চেক মূলত সাংবাদিকতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও সম্প্রতি তথ্য জানা এবং জানানোর মাধ্যম হিসেবে গণমাধ্যমের আবেদন কমে যাওয়া এবং ইন্টারনেটে তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও জনসাধারণের উন্মুক্ত বিচরণ থাকায় ফ্যাক্ট চেক-কে স্বতন্ত্র রূপ দেয়ার চেষ্টা চলছে।
তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে তথ্যের সত্যতা ও যথার্থতা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। সেই যৌক্তিকতা থেকে ফ্যাক্ট চেকের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে –
- ভুল তথ্য ও ভুয়া সংবাদের বিস্তার রোধ: ফ্যাক্ট চেকের প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ভুল তথ্য, কুতথ্য, অপতথ্য তথা অযথার্থ তথ্য এবং ভুয়া সংবাদ চিহ্নিত করে সেগুলো প্রচার ও বিস্তার রোধ করা।
- গুজব ও অপপ্রচার রোধ: রাজনৈতিক ও আদর্শিক স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে কিছু সঙ্ঘবদ্ধ চক্র প্রায়ই বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব রটায়, অপপ্রচার চালায়। ফ্যাক্ট চেকের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে এসব গুজব ও অপপ্রচার রুখে দেয়া।
- সত্য ও সঠিক তথ্যের প্রচার: ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে যথাযথ তথ্য-প্রমাণসহ প্রকৃত সত্য তথ্য উপস্থাপন করা হয়। ফলশ্রুতিতে, জনসচেতনতার পাশাপাশি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা এবং যেকোনো বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য পাওয়া নিশ্চিত হয়।
- সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা: ভুল তথ্য, গুজব, অপপ্রচার, ভুয়া সংবাদ ইত্যাদি সাধারণ মানুষেকে বিভ্রান্ত করে। ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই ও উপস্থাপন করা হলে গণমানুষ সেই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
- জনসচেতনতা সৃষ্টি: তথ্যের সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে ফ্যাক্ট চেকের অন্যতম উদ্দেশ্য এবং একারণে ফ্যাক্ট চেক বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্যাক্ট চেক বনাম ভেরিফিকেশন – Fact Check vs Verification
‘ফ্যাক্ট চেক’ বা ‘সত্যতা যাচাই’ এবং ‘ভেরিফিকেশন’ বা ‘সত্যায়ন’ শব্দদ্বয়কে সমার্থক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি তেমন নয়। ‘ভেরিফিকেশন’ মূলত ব্যাপক অর্থবোধক একটি শব্দ ও পদ্ধতি, যা সাংবাদিকতা ছাড়াও সরকারি, সামরিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। পক্ষান্তরে, ‘ফ্যাক্ট চেক’ হচ্ছে ‘ভেরিফিকেশন’-র বিশেষ একটি পদ্ধতি।
সাংবাদিকতার জগতে ‘ভেরিফিকেশন’ একটি সম্পাদকীয় কৌশল, যার মাধ্যমে সম্পাদক, সাংবাদিক এবং ফ্যাক্ট চেকাররা কোনো ঘটনা, তথ্য বা বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করেন। আবার, চাকরি এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমাদের দেয়া তথ্য সত্য প্রমাণের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে ‘ভেরিফিকেশন’ বা ‘সত্যায়ন’ করে থাকি।
অপরদিকে, ‘ফ্যাক্ট চেক’ বা ‘সত্যতা যাচাই’ সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এসব বিষয়ে ভেরিফিকেশনের বিশেষ কৌশল। গনমানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া একটি সংবাদ বা তথ্য সত্য কি মিথ্যা, সংবাদ বা তথ্যটি যথার্থ নাকি ভুল তথ্য, কুতথ্য, অপতথ্য, গুজব, অপপ্রচার অথবা ভুয়া সংবাদ – এসব চিহ্নিত, যাচাই এবং প্রচার করাই হচ্ছে ‘ফ্যাক্ট চেক’।
তথ্যসূত্র - References
- 1গবেষণাপত্র: The spread of true and false news online; লেখক: Soroush Vosoughi, Deb Roy, Sinan Aral; প্রকাশক: MIT Initiative On The Digital Economy, Science (American Association for the Advancement of Science); প্রকাশকাল: মার্চ ২০১৮;
- 2উদ্ধৃতি: “to verify the factual accuracy”; অভিধান: Merriam-Webster.com; প্রকাশনী: Merriam-Webster, Inc.;
- 3উদ্ধৃতি: “to check that all the facts in a piece of writing, a news article, a speech, etc. are correct”; অভিধান: Cambridge Advanced Learner’s Dictionary & Thesaurus; প্রকাশক: Cambridge University Press;
- 4উদ্ধৃতি: “Fact-checking has a traditional meaning in journalism that relates to internal procedures for verifying facts prior to publication, as well as a newer sense denoting stories that publicly evaluate the truth of statements from politicians, journalists, or other public figures….the term also refers more broadly to verification routines and the professional concern with factual accuracy….fact-checking consists of publishing an evidence-based analysis of the accuracy of a political claim, news report, or other public text.”; গবেষণাপত্র: Fact-Checking as Idea and Practice in Journalism; লেখক: Lucas Graves, Michelle A. Amazeen; প্রকাশক: Oxford Research Encyclopedia of Communication; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯;
- 5গ্রন্থ: ফ্যাক্ট চেকিং ও ভেরিফিকেশন হ্যান্ডবুক; লেখক: কদরুদ্দিন শিশির; প্রকাশক: ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই); প্রকাশকাল: এপ্রিল, ২০২২;