প্রযুক্তিগত বিপ্লবের এই যুগে চারদিকে তথ্যের বিপুল সমাহার। নিত্যনতুন তথ্য মুহূর্তেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেমন ছড়িয়ে দেয়া যায়, তেমনি নিমিষেই যেকোনো তথ্য জানাও যায়। আইনি বেড়াজাল কিংবা সম্পাদনার সংস্পর্শ ছাড়াই তথ্য জানানো এবং জানার এই উন্মুক্ত সুযোগকেই হাতিয়ার বানাচ্ছে কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি।
বর্তমানে শিক্ষা, গবেষণা, সচেতনতা এবং দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজকর্ম মূলত তথ্য-ভিত্তিক। আমরা কোন জিনিসটি কিনবো, কোন খাবারগুলো খাবো, এসবই নির্ধারণ করি তথ্যের ভিত্তিতে। ইন্টারনেটে আমরা কি দেখবো, তাও মূলত নির্ধারিত হয় তথ্য বা ডাটা (এলগোরিদম)-র মাধ্যমে।
বলাই বাহুল্য, এই যুগে ‘তথ্য’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং হাতিয়ার। ইন্টারনেট সেই তথ্যের অবাধ প্রবাহের অধিকারকে সুরক্ষিত করলেও তথ্যের সত্যতা এবং যথার্থতাকে নিশ্চিত করতে পারেনি। বরং, তথ্যের উৎস হিসেবে গণমাধ্যমের প্রতি এককেন্দ্রিক নির্ভরতা হ্রাসের ফলে অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ওয়েবসাইটে ভুল তথ্য, ভুয়া সংবাদ, গুজব ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে।
একারণে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন তথ্যের সত্যতা এবং যথার্থতা যাচাইয়ে প্রয়োজন পড়ছে ফ্যাক্ট চেকের। ঐতিহাসিকভাবে ‘ফ্যাক্ট চেক’ সাংবাদিকতার একটি অংশ হলেও সম্প্রতি ভুল তথ্য ও ভুয়া সংবাদের ব্যাপক প্রচার এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণে ‘ফ্যাক্ট চেক’ নিয়ে বিপুল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন।
সেই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক এবং বৃহৎ গণমাধ্যমগুলোর পাশাপাশি দেশ বা অঞ্চল-ভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থা ফ্যাক্ট চেকিং নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করছে। ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN) হচ্ছে এসকল ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অভিভাবক প্রতিষ্ঠান।
প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্ট চেকের ক্ষেত্রে তথ্যের সত্য-মিথ্যা চিহ্নিতকরণ ছাড়াও আরো কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। আইএফসিএন ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা এবং ফ্যাক্ট চেকারদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পালনীয় এমন পাঁচটি নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই নীতিমালা গুগল, ফেসবুক সহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত।
ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN)-র স্বীকৃতি এবং নিবন্ধনের আওতায় আসতে সকলকে এই নীতিমালাগুলো আবশ্যিকভাবে মেনে চলতে হয়। গুগল, ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ফ্যাক্ট চেকিং সহযোগী হিসেবে যোগদানের ক্ষেত্রেও আইএফসিএন-র স্বীকৃতি প্রয়োজন হয়।
ফ্যাক্ট চেকের নীতিমালা – Fact Check’s Code of Principles
আইএফসিএন তার নীতিমালাকে ‘নীতিগত বিধির অঙ্গীকার’ বা ‘Commitments of the Code of Principles’ হিসেবে অভিহিত করে। এর মাধ্যমে ফ্যাক্ট চেক এবং সংস্থা – উভয়ের কর্মপদ্ধতি, অর্থায়ন সহ সকল কার্যক্রমকে নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ মানদণ্ডের ভিত্তিতে পরিচালনা নিশ্চিত করা হয়।
এসম্পর্কে আইএফসিএন-র ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “এই নীতিমালা সেই সংস্থাগুলির জন্য, যারা জনস্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট বহুল প্রচারিত দাবি, বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিবৃতির যথার্থতা নিয়ে নিয়মিত নিরপেক্ষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিশ্বজুড়ে ফ্যাক্ট চেকারদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতেই এই নীতিমালা গৃহীত হয়েছে।”1উদ্ধৃতি: “This code of principles is for organizations that regularly publish non-partisan reports on the accuracy of statements by public figures and prominent institutions and other widely circulated claims related to public interest issues. It is the result of consultations among fact-checkers from around the world.”; ওয়েবপেইজ: The commitments of the code of principles; প্রকাশক: International Fact-Checking Network (IFCN)
আইএফসিএন কর্তৃক প্রণীত ‘নীতিগত বিধির অঙ্গীকার’ বা ‘Commitments of the Code of Principles’ অনুসারে ফ্যাক্ট চেকের পাঁচটি নীতি হচ্ছে –
ন্যায়পরায়ণতা ও পক্ষপাতহীনতার অঙ্গীকার – Commitment to Non-partisanship & Fairness
ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া অধিকাংশ ভুল তথ্য, ভুয়া সংবাদ এবং গুজব প্রধানত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই প্রচার করা হয়। দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়ানোর লক্ষ্যে সেসব তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়।
কিছু বাণিজ্যিক গণমাধ্যম এবং আদর্শচ্যুত সাংবাদিকও বস্তুনিষ্ঠতার বদলে পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচার করে। এসবের মূল উদ্দেশ্য থাকে রাজনৈতিক, আদর্শিক কিংবা দলীয় স্বার্থ হাসিল করা।
ফ্যাক্ট চেক সংস্থাগুলোকে অবশ্যই এই ধরণের কর্মকাণ্ড থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকতে হবে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো তথ্যকে ফ্যাক্ট চেকের বিষয়বস্তু করা যাবে না। বরং, ইতোমধ্যে যেসব তথ্য নিয়ে বিতর্ক বা সংশয় আছে, সেগুলোর ফ্যাক্ট চেক করতে হবে।
ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বা আদর্শিক কারণে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণের কোনো সুযোগ থাকবে না। প্রতিবেদনের সিধান্ত বা উপসংহার হতে হবে দলিল-প্রমাণ ভিত্তিক। প্রতিবেদক, সম্পাদক বা সংস্থার নিজস্ব মতাদর্শের ভিত্তিতে উপসংহার টেনে পাঠকদের অনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাবে না।
ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা হিসেবে আইএফসিএন কর্তৃক স্বীকৃতি পেতে ‘ন্যায়পরায়ণতা ও নির্দলীয়তার অঙ্গীকার’ নিশ্চিতকরণে নিন্মোক্ত পাঁচটি শর্ত পূরণ করতে হয়। শর্তগুলো হচ্ছে –
- দাবি যে বা যারাই দাবি করুক না কেন, আবেদনকারী (ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা) সমতুল্য সকল দাবির ক্ষেত্রে একই মানের প্রমাণ এবং বিশ্লেষণ করবে।
- আবেদনকারী (ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা) ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য একতরফাভাবে কোনো একটি বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন না। দাবির গুরুত্ব এবং প্রচার-প্রসার বিবেচনা করে যাচাইয়ের জন্য নির্বাচন করবেন। একই সাথে নিজস্ব ওয়েবসাইটে ফ্যাক্ট চেকের জন্য দাবি নির্বাচনের সংক্ষিপ্ত নীতিমালা প্রকাশ করবেন।
- আবেদনকারী (ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা) সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সম্পূরক প্রমাণ-দলিল বা তথ্যসূত্র সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করবে, যাতে পাঠকবৃন্দ প্রামাণ্য তথ্যের উৎসগুলো নিজেরাও বিশ্লেষণ করে উপসংহারে পৌঁছাতে পারে। কোনো বাণিজ্যিক বা এজাতীয় সম্পর্ক থাকলে, যা ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য উদঘাটনকে প্রভাবিত করতে পারে। আবেদনকারী সংস্থা তাও প্রকাশ করবে, যাতে যেকোনো সাধারণ পাঠক বিষয়টি বিবেচনায় করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
- আবেদনকারী (ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা) কোনো রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক প্রার্থীর সাথে সম্পৃক্ত সংগঠন নয় কিংবা মুখপাত্র নয় বা সমর্থন করে না। জনসাধারণের মাঝে আলোচিত বিষয়ে স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা ব্যতিত অন্যান্য বিষয়ে কোনো নীতিগত অবস্থানের পক্ষে বা বিপক্ষে সমর্থন দেয় না।
- আবেদনকারী (ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা)-কে তার ওয়েবসাইটে কর্মকর্তাদের নির্দলীয়তা বা নিরপেক্ষতার নীতি প্রকাশ করতে হবে। স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা ব্যতিত আবেদনকারী (ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা)-র কর্মকর্তাবৃন্দ এমন কোনো বিষয়ে ওকালতি বা নিজস্ব চিন্তাধারা প্রতিফলনের সাথে জড়াবেন না, যেই বিষয় বা তথ্য যাচাইয়ে সংস্থাটি কাজ করতে পারে। এতে জনসাধারণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সংস্থার কর্মকাণ্ডকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসাবে দেখতে পারে।
মানসম্মত ও সূত্রের স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি – Commitment to Standards & Transparency of Sources
প্রথাগত সাংবাদিকতায় সূত্রের নাম-পরিচয় গোপন রেখে, এমনকি প্রতিবেদকের নামও গোপন করে সংবাদ প্রকাশের চর্চা আছে। সূত্র এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে এধরণের চর্চা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। তবে, ফ্যাক্ট চেকের ক্ষেত্রে সূত্র গোপনের চর্চা যতটা সম্ভব, এড়িয়ে যেতে হবে।
সূত্রের পরিচয় প্রকাশে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি থাকলে সূত্র বা প্রতিবেদকের বিস্তারিত পরিচয়ের বদলে সূত্রকে নিরাপদ রেখে যতটুকু সম্ভব, সংক্ষিপ্ত পরিচয় হলেও প্রকাশ করতে হবে। এতে সূত্রের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়।
সূত্র হিসেবে দৈবচয়নের পরিবর্তে বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যক্তির মতামত নিতে হবে, যিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং বিশ্বাসযোগ্য। সুযোগ থাকলে ঘটনা বা তথ্যের প্রচার-প্রসারের সূচনাকারী সরাসরি সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মতামত নিতে হবে। ঘটনা বা তথ্যের দর্শক বা সাধারণ প্রচারকদের মতামতকে ভিত্তি করে প্রতিবেদনের উপসংহার টানা যাবে না।
অর্থাৎ, ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার সকল কর্মকাণ্ড এবং প্রতিটি প্রতিবেদনে মানসম্মত ও স্বচ্ছ সূত্রের নিশ্চয়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। আইএফসিএন-র স্বীকৃতি পেতে ‘মানসম্মত ও স্বচ্ছ সূত্রের প্রতিশ্রুতি’ নিশ্চিতকরণে নিচের চারটি শর্ত পূরণ করতে হয়। সেগুলো হচ্ছে –
- আবেদনকারী (ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা) তার ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত সকল গুরুত্বপূর্ণ দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করবে এবং সেগুলো অনলাইনে পাওয়া গেলে লিংকগুলোও দিবে, যাতে পাঠকরা চাইলে নিজেরাও সত্যতা যাচাই করতে পারে। যদি সূত্র বা প্রমাণের উৎস কোনো ব্যক্তি হয় এবং পরিচয় প্রকাশ্যে তার নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে, তাহলে সূত্রের নিরাপত্তা বজায় রেখে যতটা সম্ভব- তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
- আবেদনকারী সংস্থা দাবি কিংবা প্রমাণের প্রাথমিক বা মূল সূত্র অথবা উৎসকে গ্রহণ এবং ব্যবহার করবে, মাধ্যমিক কোনো সূত্র নয়। যদি উপযুক্ত প্রাথমিক সূত্র পাওয়া না যায়, তখন যথাযথ ব্যাখ্যা-প্রদান সাপেক্ষে মাধ্যমিক সূত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
- কোনো বিষয়ে যদি একাধিক সূত্র থাকে, সেক্ষেত্রে আবেদনকারীকে প্রত্যেকটা সূত্রের প্রধান প্রধান উপাদানগুলোকে নিরীক্ষা করতে হবে। অপরদিকে, কোনো বিষয়ে একটি মাত্র সূত্র পাওয়া গেলে প্রাসঙ্গিক প্রতিটি উপাদানগুলো পরীক্ষা করতে হবে।
- আবেদনকারী সংস্থা তার প্রতিবেদনে ব্যবহৃত সূত্রগুলোও পর্যবেক্ষণ করবে এবং সূত্র সম্পর্কে বর্ণনা দিবে যাতে পাঠকরা প্রয়োজনে সূত্র সম্পর্কে জেনে সূত্রের দেয়া তথ্যের যথার্থতা সম্পর্কে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সংস্থা ও অর্থায়নের স্বচ্ছতার অঙ্গীকার – Commitment to Transparency of Funding & Organization
ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে সংস্থার অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক – সকল কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং জনসম্মুখে তা প্রকাশ করা। প্রথাগত গণমাধ্যমে সাধারণত সাংবাদিক এবং সম্পাদকের নাম উল্লেখ থাকলেও বিস্তারিত পরিচয় থাকে না। সহ-সম্পাদক এবং অন্যান্য কলাকুশলীদের পরিচয়ও সবিস্তরে জানা যায় না।
ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার ক্ষেত্রে সম্পাদক, প্রতিবেদক সহ সকল কলাকুশলীর পরিচয়-সংক্রান্ত তথ্য নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা আবশ্যিক, যাতে পাঠকবৃন্দ সংস্থাটির প্রতিটি ব্যক্তির নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং প্রয়োজনে অভিযোগ জানাতে পারে। পাশাপাশি সংস্থার মালিকানা, সাংগঠনিক কাঠামো, আইনি ভিত্তি ইত্যাদি তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
বাণিজ্যিক গণমাধ্যমের মত বিজ্ঞাপন প্রচার করে কিংবা দর্শক-পাঠকদের থেকে পর্যাপ্ত আর্থিক প্রণোদনা নেয়ার সুবিধা থাকে না বলে অধিকাংশ ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা মূলত অনুদান গ্রহণ করে। অর্থায়নের কারণে সংস্থার ফ্যাক্ট চেকিং কার্যক্রমে বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ বা প্রভাবিত করবে না – এমন অঙ্গীকার নিশ্চিত করতে পারলে আইন-সম্মত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনুদান গ্রহণ করা যাবে এবং অনুদানের বিস্তারিত বিবরণ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা হিসেবে আইএফসিএন কর্তৃক স্বীকৃতি পেতে ‘সংস্থা ও অর্থায়নের স্বচ্ছতার অঙ্গীকার’ নিশ্চিতকরণে নিন্মোক্ত পাঁচটি শর্ত পূরণ করতে হয়। শর্তগুলো হচ্ছে –
- আবেদনকারী সংস্থা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলে ওয়েবসাইটে পূর্ববর্তী বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং আইনগত ভিত্তি বা নিবন্ধন (অলাভজনক, কোম্পানি ইত্যাদি) সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
- আবেদনকারী সংস্থা মূলধারার গণমাধ্যম বা কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশ হলে সংস্থার মালিকানা সম্পর্কে বিবৃতি দিবে।
- আবেদনকারী সংস্থার ওয়েবসাইটে সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে জানাতে হবে এবং কিভাবে ও কাদের দ্বারা সম্পাদনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তা পরিষ্কার করতে হবে।
- ওয়েবসাইটের একটি পাতায় সাংগঠনিক কাঠামো এবং সম্পাদনা পর্ষদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশ করতে হবে।
- পাঠকরা যাতে আবেদনকারী সংস্থার ওয়েবসাইট এবং সামাজিক মাধ্যমে সম্পাদনা পর্ষদের সাথে অনায়াসে যোগাযোগ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে।
পদ্ধতিগত মানদণ্ড ও স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি – Commitment to Standards & Transparency of Methodology
ফ্যাক্ট চেক বা সত্যতা যাচাই মূলত গবেষণাধর্মী একটি কাজ। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার শুরুতেই যেমন গবেষণার পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়, তেমনি ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদন তৈরিতেও প্রতিটি সংস্থার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকতে হয় এবং সেই পদ্ধতি অনুসারে প্রতিবেদনের মানদণ্ড ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়।
ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার পদ্ধতিতে কিভাবে দাবি নির্বাচন করে, কিভাবে দাবিটির সত্য-মিথ্যা যাচাই করে, দলিল-প্রমাণ হিসেবে কোন ধরণের সূত্র গ্রহণ করে, কিভাবে প্রতিবেদন তৈরি ও সম্পাদনা করে, জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিবেদনটি কিভাবে ও কোন মাধ্যমে প্রচার করে ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা হিসেবে আইএফসিএন কর্তৃক স্বীকৃতি পেতে ‘পদ্ধতিগত মানদণ্ড ও স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি’ রক্ষার্থে নিচের ছয়টি শর্ত পূরণ করতে হয়। শর্তগুলো হচ্ছে –
- আবেদনকারী (ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা) তার দাবি নির্বাচন, অনুসন্ধান, প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশের পদ্ধতি নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে।
- আবেদনকারী সংস্থা প্রধানত দাবির প্রচার-প্রসার ও গুরুত্ব বিবেচনা করে ফ্যাক্ট চেকের বিষয়বস্তু নির্বাচন করবে এবং সম্ভব হলে দাবিটি কেন ফ্যাক্ট চেকের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করবে।
- আবেদনকারী সংস্থা ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনগুলোতে প্রাসঙ্গিক সকল প্রমাণাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে, কোন সূত্রগুলো দাবিটিকে সমর্থন করে, একই সাথে কোন সূত্র অনুযায়ী দাবিটি দুর্বল বা ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান হয়, সেসব ব্যাখ্যা করবে।
- আবেদনকারী সংস্থা একই ধরণের দাবি বা তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে, দাবিটি যে বা যারাই করুক না কেন, প্রতিটি প্রতিবেদনে সমমানের দলিল-প্রমাণ ব্যবহার করবে। মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে একই ধরণের দাবিগুলো ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ডে যাচাই করা যাবে না।
- আবেদনকারী সংস্থা প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি জোগাড়ের জন্য সর্বপ্রথম যে বা যারা দাবিটি করেছেন, তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। উল্লেখ্য, (১) ইন্টারনেটে ছড়ানো দাবিগুলোর সূত্র চিহ্নিত করা প্রায়ই সম্ভব হয় না, (২) যোগাযোগের পর দাবিকারী ব্যক্তি যথাসময়ে উত্তর দিতে ব্যর্থ হলে সেকারণে প্রতিবেদন বিলম্বিত করা যাবে না, (৩) দাবিটি নিয়ে যে যাই বলুক, কোনোরূপ অজুহাত-অনুরোধের তোয়াক্কা না করে ফ্যাক্ট চেকারকে মূল দাবিটি নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে, (৪) নিরাপত্তা-জনিত বা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেউ কিছু দাবি করলে তা নিয়ে সেই ব্যক্তির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা অনুচিত।
- আবেদনকারী সংস্থা তার পাঠক/ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন দাবি সম্পর্কে ফ্যাক্ট চেকের অনুরোধ জানাতে উৎসাহিত করবে। তবে, কোন ধরণের দাবিগুলো ফ্যাক্ট চেকের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে এবং কোনগুলো হবে না, তা সম্পর্কে পাঠকদের সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে।
সংশোধনের উন্মুক্ত ও প্রতিশ্রুতিশীল অঙ্গীকার – Commitment to Open & Honest Corrections Policy
ফ্যাক্ট চেকের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে তথ্য ও সংবাদের সত্যতা এবং নির্ভুলতা নিশ্চিত করা। তাই, তথ্য ও সংবাদ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সকল সূত্র, প্রাসঙ্গিক তথ্য ও বর্ণনা, সর্বোপরি প্রতিবেদনের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য নির্ভুল এবং সুস্পষ্ট হতে হবে।
প্রামাণ্য তথ্যসূত্রের স্বল্পতা, প্রতিবেদকের অনুসন্ধানী ও বিশ্লেষণী দক্ষতা এবং সম্পাদকের বিচক্ষণতার অভাবে ক্ষেত্রবিশেষে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদনেও তথ্য বা বিশ্লেষণগত ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনের পাশাপাশি সংশোধন বা অভিযোগ জানানোর নীতিমালা থাকা জরুরি।
এই নীতিমালায় প্রতিবেদন সংশোধনের কারণ, পদ্ধতি ও সংশোধনের অনুরোধ জানানোর মাধ্যম ইত্যাদি বর্ণনা করতে হবে এবং পাঠকরা যথাযথ তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কোনো প্রতিবেদন সংশোধনের অনুরোধ জানালে তা সাদরে গ্রহণ ও সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা হিসেবে আইএফসিএন কর্তৃক স্বীকৃতি পেতে ‘সংশোধনের উন্মুক্ত ও প্রতিশ্রুতিশীল অঙ্গীকার’ সম্পর্কে ওয়েবসাইটে একটি সুষ্ঠু ও কার্যকর সংশোধন নীতিমালা প্রকাশ এবং কঠোরভাবে তা মেনে চলার পাশাপাশি পাঁচটি শর্ত পূরণ করতে হয়। সেগুলো হচ্ছে –
- আবেদনকারী ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার একটি সংশোধন বা অভিযোগ নীতি থাকতে হবে এবং ওয়েবসাইটে তা সহজেই দৃশ্যমান বা ব্যবহারযোগ্য রাখতে হবে।
- সংশোধন বা অভিযোগ নীতি বিচক্ষণতার সাথে নির্ধারণ করতে হবে এবং সেই নীতি দ্বারা কি করা হয় ও কি করা হয় না, কিভাবে গুরুতর ভুলগুলো সংশোধন করা হবে, বিশেষত যেগুলোর কারণে প্রতিবেদনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই পরিবর্তন করতে হয়, এসব বিষয়ও সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে হবে।
- কোনো প্রতিবেদনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে ভুলভ্রান্তি আছে, এমন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেলে আবেদনকারী সংস্থা প্রকাশ্যে এবং স্পষ্টভাবে তা সংশোধন করবে। মূল প্রতিবেদনের পাঠকরা যাতে সংশোধিত সংস্করণটি পড়ে এবং সংশোধন সম্পর্কে জানতে পারে, তা নিশ্চিত করতে আবেদনকারী সংস্থা তার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে।
- আবেদনকারী সংস্থা যদি ইতোমধ্যে IFCN কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে থাকে, তাহলে সংশোধন বা অভিযোগ নীতির পাতায় যে পাতায় IFCN-র স্বীকৃতিপ্রাপ্তির উল্লেখ করেছে, সেখানে IFCN-র ওয়েবসাইটের লিংক সংযুক্ত করে পাঠকদের জানাবেন যে, যদি পাঠকরা বিশ্বাস করে যে আবেদনকারী সংস্থা IFCN-র নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে, তাহলে তারা যেন IFCN-কে অভিযোগ জানাতে পারে।
- আবেদনকারী সংস্থা কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের অংশ হলে মূল প্রতিষ্ঠানটির একটি সুস্পষ্ট ও প্রতিশ্রুতিশীল সংশোধন নীতি থাকতে হবে এবং তা দৃঢ়ভাবে মেনে চলতে হবে।
এসকল নীতিমালার প্রতিটি যথাযথভাবে মেনে নিজস্ব ওয়েবসাইটে নিয়মিত ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করলে একটি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN)-র স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে পারে।2ওয়েবপেইজ: Application process for the IFCN code of principles, প্রকাশক: International Fact-Checking Network (IFCN) আবেদনের ভিত্তিতে মূল্যায়নের মাধ্যমে সংস্থাটির কার্যক্রম যথোপযুক্ত বলে বিবেচিত হলে আইএফসিএন স্বীকৃতি প্রদান করে।
আইএফসিএনের ওয়েবসাইটে স্বীকৃত ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাগুলোর তালিকা, আবেদন এবং মূল্যায়নের বিস্তারিত তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে।3ওয়েবপেইজ: Verified signatories of the IFCN code of principles, প্রকাশক: International Fact-Checking Network (IFCN) স্বীকৃত সংস্থাগুলোকে এক বছরের জন্য ‘IFCN Signatory’ ব্যাজ দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে প্রতি বছর আবেদন ও পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে তা নবায়ন করতে হয়।
তথ্যসূত্র - References
- 1উদ্ধৃতি: “This code of principles is for organizations that regularly publish non-partisan reports on the accuracy of statements by public figures and prominent institutions and other widely circulated claims related to public interest issues. It is the result of consultations among fact-checkers from around the world.”; ওয়েবপেইজ: The commitments of the code of principles; প্রকাশক: International Fact-Checking Network (IFCN)
- 2ওয়েবপেইজ: Application process for the IFCN code of principles, প্রকাশক: International Fact-Checking Network (IFCN)
- 3ওয়েবপেইজ: Verified signatories of the IFCN code of principles, প্রকাশক: International Fact-Checking Network (IFCN)