আমরা কেউ কোমল স্বভাবের, কেউ একটু উগ্র। কারো অভ্যাস কম কথা বলার, কেউ আবার অনেক কথা বললেও সাজিয়ে-গুছিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে সবার মাঝে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
সাংবাদিকতার পরিধি ও প্রায়োগিকতার স্বার্থে, ঘটনার মূল্যায়ন ও বর্ণনার প্রয়োজনে সংবাদেরও মানুষের মত নানাবিধ ধরণ, স্বভাব হয়ে থাকে।
পাঠক-দর্শকের চাহিদা ও প্রবণতা বিচারে ভিনদেশি সংবাদের চেয়ে স্থানীয় সংবাদে গণমাধ্যমগুলো বেশি গুরুত্বারোপ করে, কিছু সংবাদ তাৎক্ষনিকভাবে প্রকাশ হলেও কিছু সংবাদ প্রকাশিত হয় কয়েকদিন পর, কোনো সংবাদের বিবরণ হয় ব্যাখ্যামূলক, কোনোটি হয় সংক্ষিপ্ত।
ঘটনার স্থান-কাল ও পরিণাম, পাঠকের চাহিদা ও প্রবণতা, সংবাদের ধরণ ও প্রকৃতি ইত্যাদির ভিত্তিতে তাই সংবাদকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। এসব প্রকরণ বা বিভাজন সংবাদের চূড়ান্ত মানদণ্ড নয়, বরং সংবাদের স্বরূপ অন্বেষণ এবং সাংবাদিকতার চর্চাকে সরলীকরণের প্রচেষ্টা মাত্র।
সংবাদের প্রকারভেদ – Types of News
সংবাদের প্রধান অবলম্বন ঘটনা। ঘটনা কোথায় এবং কখন ঘটেছে, ঘটনার ফলাফল বা পরিণাম কি, ঘটনার গুরুত্ব কতটুকু, এবং সংবাদে ঘটনাকে কিভাবে বর্ণনা করে হচ্ছে – এসব দৃষ্টিকোণ থেকেই মূলত সংবাদকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। সংবাদের প্রকরণ প্রধানত পাঁচ ধরণের। সেগুলো হলো –
- ভৌগলিক প্রকারভেদ – Geographical Types
- পরিণামগত প্রকারভেদ – Consequential Types
- প্রকৃতিগত প্রকারভেদ – Characteristic Types
- উপস্থাপনগত প্রকারভেদ – Presentational Types
- বর্ণনাগত প্রকারভেদ – Descriptive Types
ভৌগোলিক প্রকারভেদ – Geographical Types
সংবাদের প্রাথমিক শ্রেণীকরণ হয় ঘটনাস্থল বা ঘটনার ভৌগলিক অবস্থান অনুসারে। ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় সংবাদকে বলা হয় স্থানীয় সংবাদ (Local News), দেশীয় সংবাদ – Country News, বৈদেশিক সংবাদ (Foreign News)।
স্থানীয় সংবাদ – Local News
পত্রিকা বা গণমাধ্যম যে স্থান থেকে প্রকাশিত বা সম্প্রচারিত হয়, সেখানকার সংবাদই স্থানীয় সংবাদ। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে অধিকাংশ গণমাধ্যম রাজধানী-কেন্দ্রিক হলেও পূর্বে তা ছিল স্থান বা জেলা, উপজেলা, মফস্বল ভিত্তিক। যেমন: চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক আজাদি’, বগুড়ার ‘দৈনিক করতোয়া’, সিলেটের ‘দৈনিক সিলেটের ডাক’ প্রভৃতি।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’ চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় পত্রিকা। পত্রিকাটিতে ছাপানো অধিকাংশ সংবাদের ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক এসব সংবাদই পত্রিকাটির জন্য স্থানীয় সংবাদ। যেমন –
“জামালখান মোড়ে বোধনের গণহত্যা দিবস স্মরণ”
“পতেঙ্গায় কিশোরদের মাঝে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ”
“আনোয়ারায় গ্রাম ডাক্তার সমিতির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী”
দৈনিক আজাদীতে ছাপানো এসব সংবাদ নিয়ে দেশব্যাপী পাঠকদের তেমন আগ্রহ না থাকলেও স্থানীয় পাঠকদের কাছে সংবাদগুলোর আবেদন আছে। তাই স্থানীয় পত্রিকায় স্থানীয় সংবাদেই প্রাধান্য দেয়া হয়।
আবার বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা বা গণমাধ্যমও স্থানভেদে ভিন্ন সংস্করণ প্রচার করে। প্রথম আলো চট্টগ্রামে পত্রিকাটির আলাদা সংস্করণ প্রকাশ করে থাকে। এই সংস্করণের অধিকাংশ সংবাদ হয় চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক তথা স্থানীয় সংবাদ।
প্রধান সংস্করণেও বিভিন্ন স্থান নিয়ে নির্ধারিত পাতা বা অংশ থাকে, যেখানে স্থানীয় সংবাদ উপস্থাপন করা হয়। যেমন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগ’ শিরোনামে পত্রিকার এক পাতায় চট্টগ্রাম বিভাগের স্থানীয় সব সংবাদ ছাপানো হয়।
দেশীয় সংবাদ – Country News
যেসব ঘটনা গণমাধ্যমের প্রকাশস্থলের বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়, সেগুলো দেশীয় সংবাদ। দেশাত্মবোধ, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি জানা এবং সচেতনতার জন্য পাঠক-দর্শকদরা এসব সংবাদের প্রতি আগ্রহী হন। যেমন –
“ঢাকার একুশে বইমেলায় বোমা হামলার হুমকি”
“পদ্মা সেতুতে দেশের প্রথম পাথরবিহীন রেলপথ”
“বগুড়ার দুই আসনেই হিরো আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল”
এই সংবাদগুলোও দৈনিক আজাদী থেকে সংগৃহীত। এসব সংবাদের ঘটনাস্থল চট্টগ্রামের বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে। পাঠকদের আগ্রহের কারণেই পত্রিকাটি স্থানীয় সংবাদের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সংবাদও ছাপাচ্ছে।
অন্যদিকে, প্রথম আলোর মত জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর অধিকাংশই সংবাদই এধরনের। এসব গণমাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে দেশের সামগ্রিক ঘটনাবলি বিচার-বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
বৈদেশিক সংবাদ – Foreign News
মানুষের কৌতূহলের সীমা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ, এমনকি মহাবিশ্ব পর্যন্ত। গণমাধ্যমে তাই দেশের বাহিরে তথা অন্যান্য দেশের সংবাদও প্রকাশিত হয়। যেমন –
“ইরানে স্কুলে যাওয়া ঠেকাতে মেয়েদের বিষপ্রয়োগ”
“প্রথমবারের মতো লিথিয়ামের খনি মিলল ভারতে”
“মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন গ্রেপ্তার”
সাধারণত স্বল্পসংখ্যক সচেতন পাঠকই ভিনদেশি খবরাখবর নিয়ে উৎসুক থাকে। তাই স্থানীয় এবং দেশীয় সংবাদের তুলনায় বৈদেশিক সংবাদের গুরুত্ব এবং গণমাধ্যমে এর স্থানও কম।
আজকাল মহাকাশ, চাঁদে বা মঙ্গলে অভিযানের মত পৃথিবীর বাইরের ঘটনাগুলো নিয়েও প্রায়ই সংবাদ হচ্ছে। পৃথিবীর বাইরে মহাবিশ্বে সংঘটিত ঘটনার সংবাদকে এ বিবেচনায় বৈশ্বিক সংবাদ নামে হয়তো অভিহিত করা যেতে পারে।1গ্রন্থ: সাংবাদিকতা; লেখক: আর রাজী; প্রকাশক: ভাষাচিত্র; প্রকাশকাল: মে, ২০১৬;
পরিণামগত প্রকারভেদ – Consequential Types
ঘটনার ফলাফল বা পরিণামের ব্যাপ্তি কতটা, তার ভিত্তিতে সংবাদকে আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রেণিতে বিভক্ত হয়। নামকরণের দিক থেকে এগুলো সংবাদের ভৌগলিক প্রকারভেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও এধরনের সংবাদের মূল ভিত্তি ঘটনার তাৎপর্য, ঘটনার স্থান নয়। যথা –
আঞ্চলিক সংবাদ – Regional News
যেসব ঘটনার ফলাফল, পরিণাম বা তাৎপর্য নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ, সেগুলো আঞ্চলিক সংবাদ। অঞ্চল কখনো মাত্র একটি গ্রাম হতে পারে, কখনো আবার একটি উপজেলা বা জেলা হতে পারে। একাধিক জেলা নিয়ে গঠিত বিভাগ বা বিশেষ এলাকাও অঞ্চল হতে পারে। যেমন –
“কালুরঘাট সেতুর উভয় প্রান্তে স্থাপন হচ্ছে উচ্চতা প্রতিবন্ধক”
“বাঁশখালীতে র্যাবের অভিযানে ৪ জলদস্যু অস্ত্রসহ গ্রেফতার”
“কক্সবাজারে কভার্ডভ্যান-সিএনজি অটোরিকশার সংঘর্ষে নারী নিহত”
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদী’ থেকে সংগৃহীত এসব সংবাদ আঞ্চলিক সংবাদ। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রকাশিত আঞ্চলিক পত্রিকাগুলো এসব সংবাদ নাও ছাপাতে পারে। কারণ এসব ঘটনার তাৎপর্য অন্যান্য অঞ্চলে নেই।
জাতীয় পত্রিকায় আঞ্চলিক সংবাদ হিসেবে এসব সংবাদ ছাপানো হলেও সেগুলো থাকবে ভিতরের কোনো পাতায় সংক্ষিপ্তাকারে। কেননা জাতীয় পর্যায়ে এসব সংবাদের বিশেষ তাৎপর্য নেই।
জাতীয় সংবাদ – National News
যেসব ঘটনার সংবাদ সমগ্র দেশবাসীকে সম্পৃক্ত করার দাবি রাখে, সেগুলো জাতীয় সংবাদ। জাতীয় সংবাদের উৎপত্তিস্থল দেশের যেকোনো অঞ্চলেই হতে পারে। কিন্তু এর ফলাফল বা পরিণামে জাতীয় জীবন তথা দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রভাবিত হয়। যেমন –
“চট্টগ্রামে টাইগারদের স্মরণীয় জয়”
“কমেছে সামুদ্রিক ও মিঠা পানির মাছের সরবরাহ”
“বঙ্গবন্ধু টানেলের ৯৬.৫ শতাংশ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন”
দৈনিক আজাদীর এসব সংবাদের ঘটনাস্থলও চট্টগ্রাম অঞ্চল। তবুও এগুলো জাতীয় সংবাদ। দেশের সকল গণমাধ্যম এধরনের সংবাদ ছাপিয়ে থাকে। কারণ ক্রিকেটে বাংলাদেশের জয়, দেশে মাছের সরবরাহ কমে যাওয়া কিংবা কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণের ফলাফল সমগ্র জাতিকে বিজড়িত করে।
ঘটনাস্থল যেই অঞ্চলেই হোক না কেনো, জাতীয় স্বার্থ বা দেশের অধিকাংশ মানুষকে আগ্রহী করে তোলে, এমন যেকোনো ঘটনাই জাতীয় সংবাদে পরিণত হয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদ – International News
যেসব ঘটনা একাধিক দেশের মানুষ কিংবা সমগ্র বিশ্বাসীকে প্রভাবিত করে, সেগুলোই আন্তর্জাতিক সংবাদ। এক্ষেত্রে ঘটনা যেই অঞ্চল বা দেশেই ঘটে থাকুক না কেন, ঘটনার প্রভাবই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠবে। যেমন –
“তুরস্কে ভবনে আটকে পড়া বাংলাদেশি উদ্ধার”
“মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ক্যান্সার শনাক্ত”
“ইউক্রেনজুড়ে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত অন্তত ৯”
দৈনিক আজাদীর এই সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখবো, ঘটনাগুলো ঘটেছে কোনো একটি দেশে কিন্তু সমগ্র বিশ্বেই ঘটনাগুলো মানুষের আলোচনার শীর্ষে।
প্রথম ঘটনার দিকেই দৃষ্টি দেয়া যাক। সিরিয়া-তুরস্কের এই ভূমিকম্প স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এতে কেবল দেশ দুটির মানুষই নয়, বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বহু দেশের মানুষ হতাহত হয়েছে। ঘটনার ফলাফল বা পরিণামের এই ব্যাপক ব্যাপ্তির জন্যই এটি আন্তর্জাতিক সংবাদ।
আবার বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অসুস্থ হওয়া কিংবা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলাফলও সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দেয়। এসব ঘটনার প্রভাব নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল বা দেশে সীমাবদ্ধ নয়।
আমরা প্রায়ই দেশের বাহিরের সংবাদ বা বৈদেশিক সংবাদকে আন্তর্জাতিক সংবাদ ভেবে গোলমাল বাধিয়ে দেই। প্রকৃতপক্ষে কোনো ঘটনার সংবাদ বৈদেশিক সংবাদ হিসেবে নির্ধারিত হয় ঘটনার উৎপত্তিস্থল দ্বারা, যেখানে ঘটনার ফলাফল, পরিণতির মাত্রা বা ব্যাপ্তি নির্ধারণ করে কোন ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদ।
তুরস্কে ছোটখাটো ভূমিকম্প হলে সেটি বিদেশের সংবাদ হিসেবে দেশীয় পত্রিকায় স্থান পেতেও পারতো, আবার না পেলেও পাঠক-দর্শকদের তেমন দাবি থাকত না। আবার যেসব দেশের সাথে তুরস্কের রাজনৈতিক বৈরিতা আছে, সেসব দেশের গণমাধ্যম কখনোই সংবাদটি প্রকাশ করত না।
কিন্তু যখন তুরস্কে ভূমিকম্পে নিহত হাজার হাজার মানুষের অনেকেই বিভিন্ন দেশের নাগরিক বলে জানা গেলো, তখন বিশ্বের সকল দেশের গণমাধ্যমেই গুরুত্বের সাথে সংবাদটি প্রচারিত হলো। পরিণত হলো আন্তর্জাতিক সংবাদে।
তদ্রূপ, অখ্যাত কোনো দেশের রাষ্ট্রপতি অসুস্থ হওয়া বা ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তে গোলাগুলি আমাদের দেশের গণমাধ্যমে সর্বোচ্চ বৈদেশিক সংবাদ হিসেবে স্থান করে নিতে পারে, কখনোই বিশ্বগণমাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংবাদ হিসেবে প্রচারিত হবে না।
আবার নোবেলজয়ী ড. ইউনুসের কোন কর্মকাণ্ড আমাদের গণমাধ্যমে স্থানীয় বা আঞ্চলিক, দেশীয় বা জাতীয় সংবাদ হিসেবে প্রচারিত হলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সেগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদও হতে পারে।
বস্তুত, কোনো সংবাদ স্থানীয়, দেশীয় না বৈদেশিক, সেটি নির্ধারণের মাপকাঠি ঘটনার উৎসস্থল। পক্ষান্তরে ঘটনার ফলাফল বা পরিণামের ব্যাপ্তি নির্ধারণ করে সংবাদ আঞ্চলিক, জাতীয় না আন্তর্জাতিক।
প্রকৃতিগত প্রকারভেদ – Characteristical Types
ঘটনার গতি-প্রকৃতি, চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যের আলোকেও সংবাদ কয়েক ধরণের হয়। প্রকৃতিগত প্রকরণের মূল ভিত্তি হচ্ছে সংবাদ মূল্য। কিছু সংবাদ তাৎক্ষনিক বা যত দ্রুত সম্ভব উপস্থাপন করতে হয়, কিছু সংবাদ দিন-কয়েকের মধ্যে প্রকাশ করলেও চলে। আবার কিছু সংবাদের সন্ধান পাওয়া মাত্রই অন্য সব সংবাদ বাদ দিয়ে সেটিই প্রচারের দাবি রাখে। এসবের ভিত্তিতে সংবাদ চার ধরণের। এগুলো হচ্ছে –
কোমল সংবাদ – Soft News
যেসব সংবাদ তাৎক্ষনিকভাবে প্রকাশ না করলেও চলে, দু’চারদিন এমনকি সপ্তাখানেক পর প্রকাশ করলেও সংবাদ মূল্যের তারতম্য ঘটে না, সেগুলো কোমল বা লঘু সংবাদ। যেমন –
“মহাকবি মধুসূদনের শহরে কৃতী সংবর্ধনা, নেচে-গেয়ে দিন পার”
“হাতখরচের টাকায় চলচ্চিত্র বানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা”
“আতিথেয়তায় মুগ্ধ ভূপর্যটক অক্ষয় ভগত, আবার আসতে চান বাংলাদেশে”
এগুলো ফিচারধর্মী সংবাদ। ফিচার এমন এক ধরণের সংবাদ, যার অন্তর্নিহিত নির্যাসের কাছে সময়োপযোগীতা হার মেনে যায়। পাঠক নিজ আগ্রহেই এসব সংবাদ পড়ে, সময়ের বাছ-বিচার করে না।
এসব সংবাদের ধরণ নরম বা কোমল, সংবাদ মূল্য কম বা লঘু। সামাজিক অনুষ্ঠান, ব্যক্তি-বিশেষের অর্জন, আবেগ-অনুভূতি, জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি সম্পর্কিত এধরণের সংবাদগুলো কোমল সংবাদ।
পরম সংবাদ – Hard News
ঘটনার গুরুত্ব যদি হয় পরম বা চরম মাত্রার, সংবাদটি যত দ্রুত সম্ভব প্রচার করা যদি জরুরি হয়, তাহলে সেগুলো পরম সংবাদ। পরম সংবাদকে চরম সংবাদ, তরতাজা সংবাদ, কড়া খবর ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। ইংরেজিতে বলা হয়, Hard News, Hot News এবং Absolute News।
এধরণের সংবাদ পচনশীল – দ্রুততম সময়ে উপস্থাপন না করলে এক্ষেত্রে সংবাদের মূল্যই থাকে না। আজকের পরম সংবাদগুলো আগামীকালের পত্রিকায় পড়তে পাঠকরা উদগ্রীব থাকেন, তরতাজা সংবাদগুলো জানতে দর্শকরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় টেলিভিশনের সামনে বসেন। যেমন –
“চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টরসহ ১৮ পদ থেকে ১৬ শিক্ষকের পদত্যাগ”
“নারায়ণগঞ্জে সাততলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে কাউন্সিলরের স্ত্রীর মৃত্যু”
“কামারখন্দে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ, আহত ২০”
এসব সংবাদ কয়েকদিন পর প্রকাশ করলে সংবাদের সময়োপযোগীতা বা মূল্য থাকবে না। কাগজের পত্রিকা হলে ঘটনার পরদিনই ছাপাতে হবে, টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়ায় তাৎক্ষনিক সম্প্রচার করতে হবে।
দুর্ঘটনা, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় বিষয়, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কথা ও কাজ ইত্যাদি ঘটনা এধরণের সংবাদের উপযোগ দেয়।
স্থানিক সংবাদ – Spot News
আকস্মিক তবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সংবাদকে স্থানিক সংবাদ বা Spot News বলা হয়। আকস্মিক বা অপ্রত্যাশিত, তাৎক্ষনিক বা সাম্প্রতিক, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বা সুদূরফলপ্রসারী ঘটনা স্থানিক সংবাদ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যেমন –
“পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে, জানা যাবে আজ”
“মারা গেছেন যুক্তরাজ্যের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ”
“সায়েন্স ল্যাবে তিন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে”
এসব ঘটনা অন্য যেকোনো ঘটনার চেয়ে বেশি গুরুত্ববহ কিন্তু আকস্মিক। এসব ঘটনা বলেকয়ে ঘটে না, ঘটনার শেষে কি হবে তাও কেউ জানে না, কিন্তু অনিশ্চিত কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তা সবারই জানা।
এমন ঘটনার সন্ধান পেলে টেলিভিশনগুলো অন্য সব অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সংবাদটি সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে। শেষ মুহূর্তে এমন সংবাদ পেলেও পত্রিকাগুলো প্রথম পাতার পৃষ্ঠাসজ্জা বদলে সেই সংবাদটিকে প্রধান সংবাদ আকারে ছাপায়।
স্থানিক সংবাদের জন্য গণমাধ্যমগুলো ঘটনা সম্পর্কে জানার সাথেসাথেই সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ এক বা একাধিক সাংবাদিক, প্রয়োজনে সম্পাদক-পর্যায়ের কাউকে সমন্নয়ক হিসেবে ঘটনাস্থলে প্রেরণ করে। তারা ঘটনাস্থল থেকে কোনো তথ্য পাওয়া মাত্রই গণমাধ্যমে প্রেরণ করতে থাকে। ঘটনাস্থল থেকে সরেজমিনে ঘটনার সংবাদ তৈরি করা হয় বলে স্থানিক সংবাদকে সরেজমিন সংবাদ বা প্রতিবেদনও ডাকা হয়।
স্থানিক সংবাদ মূলত পরম সংবাদেরই চরম পর্যায়। যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাষ্ট্রীয় ঘটনা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড যখন চূড়ান্ত আকার ধারণ করে, তখন সেগুলো স্থানিক সংবাদ হিসেবে প্রচারিত হয়।
উপস্থাপনগত প্রকারভেদ – Presentational Types
ঘটনার উৎপত্তিস্থল, পরিণাম এবং প্রকৃতি – এসবের ভিত্তিতে সংবাদের উপস্থাপনার ধরণও নির্ধারিত হয়। এই বিষয়গুলোই নির্ধারণ করে সংবাদ বিবরণী সংক্ষিপ্ত নাকি বিস্তারিত এবং সহজ-সরল নাকি আলঙ্কারিক ভাষায় হবে, পত্রিকার প্রছদে নাকি ভিতরের পাতায় স্থান পাবে, টেলিভিশনের সংবাদ অনুষ্ঠানে সচিত্র প্রতিবেদন নাকি মৌখিক বর্ণনা থাকবে।
উপস্থাপনগত অর্থাৎ, পাঠক-দর্শকের কাছে সংবাদ কিভাবে উপস্থাপন বা পরিবেশন করা হচ্ছে, তার ভিত্তিতে সংবাদকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা –
সরল সংবাদ – Straight News
সরল-সহজ বর্ণনায় উপস্থাপিত সংবাদই সরল সংবাদ। এধরনের সংবাদে উৎস বা সূত্র থেকে ঘটনার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাই সরাসরি সংবাদ হিসেবে উপস্থান করা হয়। যেমন –
“রাজধানীতে মাদক বিক্রি ও সেবনের অভিযোগে গ্রেপ্তার ৩৮”
“রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ”
“রাজবাড়ীতে ট্রেনের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী স্কুলছাত্র নিহত”
এই সংবাদগুলোর ধরণই এমন যে, এগুলো রূপক বা আলংকারিক শব্দ-বিবর্জিত হবে। সাংবাদিকের নিজস্ব মতামত বা বাড়তি কোনো তথ্য থাকবে না। একদম সোজাসাপ্টা ভাষায় যা ঘটেছে, তাই উপস্থাপন করতে হবে।
গুরু বা তরতাজা সংবাদের উপস্থাপন সাধারণত এই পদ্ধতিতেই হয়। ইংরেজিতে সরল সংবাদকে Straight News-র পাশাপাশি Straight Jacket News নামেও অভিহিত করা হয়।
সজ্জিত সংবাদ – Spread News
সাধারণ ঘটনাকেই আলংকারিক শব্দ ও বাক্য, আকর্ষণীয় চিত্র ও নকশায় অসাধারণ করে উপস্থাপনই সজ্জিত সংবাদ। এক্ষেত্রে ঘটনাকে কলা-কৌশলে সজ্জিত করে ঘটনার প্রকৃত গুরুত্বকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়, আকর্ষণীয় শিরোনাম দেখে পাঠকরা সংবাদটি পড়তে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠে। যেমন –
“স্পাইডারম্যানদের ভয়ে রাজধানীবাসী”
“ওসি প্রদীপ কোথায়, জানে না চট্টগ্রাম নগর পুলিশ”
“মেসি না রোনালদো, কাকে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হচ্ছে গুগলে”
প্রথম সংবাদের মূল ঘটনা রাজধানীর বাসাবাড়িতে গ্রিল কেটে চুরি। চোরকে স্পাইডারম্যান সাজিয়ে এই সংবাদটি উপস্থাপন করা হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনায় একটি মামলায় পুলিশ আদালতকে জানিয়েছে – ওসি প্রদীপ কোথায় আছে, তারা তা জানে না! এতে পাঠকের মনে হতে পারে, ওসি প্রদীপ জেল থেকে পালিয়েছে, যদিও সে এখনো জেলেই আছে। তৃতীয় সংবাদে সাধারণ ঘটনাকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মেসি-রোনাল্ডোর মত তারকাদের গুগলে খোঁজা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ না হলেও তাদের নিয়ে সমর্থকদের যে দ্বন্দ্ব, সেই আগুনে ঘি ঢালার মত শিরোনামে সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছে।
অথচ এসবই আমাদের নিত্যদিনের পরিচিত ঘটনা। এক সময় এসব ঘটনা নিয়ে আগ্রহ থাকলেও সময়ের সাথে তা স্লান হয়ে যায়। কিন্তু রূপক শব্দ বা বাক্য দিয়ে সাজিয়ে সেসব ঘটনাকেই পুনরায় আগ্রহোদ্দীপক সংবাদে পরিণত করা হয়েছে।
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ – Objective News
ঘটনা যেমনটি ঘটেছে, সামগ্রিকভাবে হুবহু তা-ই উপস্থাপিত হলে সেটি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদে সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের স্বকীয়তা, চিন্তা-চেতনা, মতামত বিন্দুমাত্র স্থান পায় না।
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ হয় পক্ষপাতহীন। এতে বিশেষ কোনো পক্ষের মতামত প্রতিফলিত হয় না। ঘটনার কারিগর, ভুক্তভোগী বা প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বলে, যেভাবে বলে, ঠিক তাই উপস্থাপন করা হয়।
সাংবাদিক ঘটনার অনুসন্ধান করে নিজের ধারণা-অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে না। সরেজমিনে যা দেখে বা শোনে, তাই সংবাদ আকারে পরিবেশন করে।
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ মূলত সরল সংবাদের বর্ধিত রূপ, যেখানে সহজ-সরল ভাষায় বর্ণনার পাশাপাশি বিভিন্ন উৎস ও সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য উল্লেখপূর্বক কোনোরূপ কাটছাঁট ব্যতিতই ঘটনার যথাযথ উপস্থাপন করা হয়।
কর্পোরেট মিডিয়ার এই যুগে প্রায় সকল গণমাধ্যমই বিশেষ বাণিজ্যিক গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত, রাজনৈতিক বা মতাদর্শিকভাবে প্রভাবিত। তাই এধরনের সংবাদ দুষ্প্রাপ্য।
ব্যাখ্যামূলক সংবাদ – Interpretative News
সব ঘটনার সমীকরণ সরলসোজা বর্ণনায় মিলে যায় না। কিছু ঘটনা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। প্রয়োজন পরে ঘটনার গভীরে গিয়ে কার্যকারণ তলিয়ে দেখার। তারপর ঘটনার নেপথ্য কারণ, ভবিষ্যত ফলাফল কিংবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সহ সুবিস্তৃত বর্ণনায় সাজানো হয় সেই ঘটনার সংবাদ। এধরণের সংবাদকে বলা হয় ব্যাখ্যামূলক সংবাদ।2গ্রন্থ: সংবাদ : লেখা ও সম্পাদনা; লেখক: সিকান্দার ফয়েজ; প্রকাশনী: বাংলা একাডেমী; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০১; যেমন –
“বন্য প্রাণীর বেচাকেনা ১৩ জেলায়, পাচার ভারতসহ নানা দেশে”
“ঢাকা, সিটি ও আইডিয়াল কলেজ শিক্ষার্থীদের দ্বন্দ্বের শুরু কবে, নেপথ্যে কী”
“ইসলামি দলগুলো যেন বিএনপির দিকে না যায়, সেই চেষ্টা আওয়ামী লীগের”
এসব সংবাদ সরল বা বস্তুনিষ্ঠও নয়, আবার সজ্জিত সংবাদও না। অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন তবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘটনার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের বিচার-বিশ্লেষণ দিয়ে সংবাদগুলো পরিবেশন করা হয়েছে।
বলা যেতে পারে, একটি বৃহত্তর ঘটনা প্রবাহের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনই হচ্ছে ব্যাখ্যামূলক সংবাদ। এক্ষেত্রে সাংবাদিক অনুসন্ধান, তথ্য, পরিসংখ্যান এবং ঘটনার পূর্বাপর নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ সহযোগে সংবাদ উপস্থাপন করেন।
মন্ময়ী সংবাদ – Subjective News
কোনো ঘটনার সংবাদ বিবরণীতে যখন সাংবাদিক তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি বা গণমাধ্যম নিজস্ব আদর্শ সংযুক্ত করে তা উপস্থাপন করে, তখন সেটি মন্ময়ী সংবাদ। সাধারণত, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, ফিচার, মতামত, সাক্ষাৎকার এধরণের সংবাদের অন্তর্ভুক্ত। যেমন –
“সাকিবের ক্যাপ কেন ‘ব্যাট’ হলো?”
“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন : সংশোধন নয়, পুরোপুরি বাতিল করা হোক”
“এসভিবি: মার্কিন ব্যাংকের ধস কি ২০০৮ সালের মতো আর্থিক সংকট শুরু করতে পারে”
সংবাদগুলো প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতা থেকে সংগৃহীত। ভাষাগত মাধুরী আর বিশ্লেষণের সংমিশ্রণে সাজানো এসব সংবাদে কোনো ঘটনার সরাসরি সংবাদ উপস্থাপন হয় নি।
মন্ময়ী সংবাদ জুড়ে মন্তব্য সর্বাধিক প্রাধান্য পায় বলে একে মন্তব্যাশ্রয়ী সংবাদ নামেও অভিহিত করা হয়। সাক্ষাৎকারধর্মী সংবাদে সাক্ষাৎকারদানকারী ব্যক্তির মন্তব্য প্রাধান্য পায়, যদিও সাংবাদিকই সুকৌশলে তাকে দিয়ে কথা বলিয়ে থাকেন।
মন্ময়ী সংবাদ – সম্পাদকীয় বা সাক্ষাৎকার, যাই হোক না কেন, নিজ দৃষ্টিভঙ্গি বা মতাদর্শ উল্লেখপূর্বক সংযত মাত্রায় অন্তর্ভুক্ত করলে পাঠক-দর্শক তা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু কূটকৌশলের মাধ্যমে অতিমাত্রায় এসব মিশ্রিত এবং রঞ্জিত করে সংবাদ উপস্থাপন করলে তা হয়ে যায় হলুদ সাংবাদিকতা।
ব্যাখ্যামূলক সংবাদে যেখানে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বা বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য সংযুক্ত করা হয়, সেখানে মন্ময়ী সংবাদে সংযুক্ত করা হয় সাংবাদিক, সংবাদপত্র বা বিশেষ ব্যক্তির মতামত। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদে সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের নিজস্ব চিন্তাধারা মোটেও প্রতিফলিত করা হয় না। কিন্তু মন্ময়ী সংবাদে সাংবাদিক, সংবাদপত্র বা বিশেষ ব্যক্তির চিন্তাধারা অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকে।
এসব কারণে অনেকে মন্ময়ী সংবাদকে ‘সংবাদ’ বলতে নারাজ। তাদের মতে, এধরণের সংবাদে মূলত সংবাদের বিচার মূল্য (Value of Judgement) উপস্থাপন করা হয়। তাই এগুলোকে মতামত (Opinion), সংবাদ বিশ্লেষণ (News Analysis) বলা যেতে পারে।
বর্ণনাগত প্রকারভেদ – Descriptive Types
সংবাদ প্রতিবেদনের বর্ণনাগত গভীরতার ভিত্তিতে সংবাদ দুই ধরণের হয়ে থাকে। সেগুলো হচ্ছে –
উপরিতল সংবাদ – Surface News
ঘটনার সাদামাটা বর্ণনাই উপরিতল সংবাদ। এধরনের সংবাদে সাংবাদিক খালি চোখে যা দেখে, প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে যা শোনে কিংবা নির্ভরযোগ্য উৎস ও সূত্র থেকে যেসব বর্ণনা পায়, সেসবের ভিত্তিতেই সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করে। যেমন –
“সড়ক দুর্ঘটনায় চার জেলায় সাংবাদিকসহ ৫ জন নিহত”
“নারায়ণগঞ্জে বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটে বিস্ফোরণ, মা ও ছেলে দগ্ধ”
“আস্থা বাড়াতে রাজনৈতিক মামলা ও গ্রেপ্তার এড়ানোর পরামর্শ যুক্তরাজ্যের”
এই সংবাদগুলোর বর্ণনা খুবই সাধারণ। বিভিন্ন উৎস ও সূত্র এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ঘটনার যেই বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে, তাই সংবাদ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঘটনাগুলো কেন ঘটেছে বা ঘটনার পিছনেও ঘটনা আছে কিনা, সেসব খতিয়ে দেখা হয় নি।
পাঠক-দর্শকদের ঘটনার মৌলিক ধারণা দেয়া বা প্রাথমিক তথ্য জানানোই এধরনের সংবাদের প্রধান উদ্দেশ্য।
নিগূঢ় সংবাদ – In-depth News
ঘটনার নিগূঢ় বা গভীরতম বর্ণনা সম্বলিত সংবাদই নিগূঢ় সংবাদ। এক্ষেত্রে সাংবাদিক যা দেখেন বা শোনেন, কেবল সেসবের ভিত্তিতেই সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করে ফেলেন না। ঘটনার গভীরে গিয়ে তলিয়ে দেখেন – ঘটনাটি নিত্যনৈমিত্তিক বা সাধারণ কোনো ঘটনা নাকি ঘটনার আড়ালে আরও ঘটনা আছে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বা সুদূর-প্রসারী উদ্দেশ্য নিয়ে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। যেমন –
“করোনা নিয়ে ট্রাম্পের গোপন কর্মকাণ্ড ফাঁস”
“চীনে বিক্ষোভকারীদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না”
“কানাডায় ট্রাক চাপায় মুসলিম পরিবারের ৪ জনকে হত্যা”
সাধারণ দৃষ্টিতে তৃতীয় সংবাদের মূল ঘটনা মনে হতে পারে সড়ক দুর্ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছে। কিন্তু ঘটনার গভীরে অনুসন্ধান করে সাংবাদিক জানতে পেরেছে – এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং বিদ্বেষ থেকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।
দ্বিতীয় সংবাদের ক্ষেত্রেও ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান না করলে জানা যেতো না যে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি সাধারণ অপরাধের ঘটনা নয়, বরং চিনে সরকারি নীতির বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভ করেছে, তারাই নিখোঁজ হচ্ছে।
আর প্রথম ঘটনার নিগূঢ় তাৎপর্য হচ্ছে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সংবাদ সম্মেলনে যেসব তথ্য ও গ্রাফ দেখিয়েছেন, সেগুলো কোনো বিশেষজ্ঞের তৈরি করা ছিল না। তিনি নিজের মনগড়া তথ্য উপস্থাপন করেছেন।
অনুসন্ধানী সংবাদ, ব্যাখ্যামূলক সংবাদ এবং গবেষণাভিত্তিক সংবাদ নিগূঢ় সংবাদের অন্তর্ভুক্ত। সাংবাদিকের গন্ধ শোঁকার নাক ও সজাগ দৃষ্টি এবং পাঠকের আগ্রহ নিগূঢ় সংবাদ প্রতিবেদনের জন্ম দেয়।
নাম যাই হোক না কেন, সংবাদে সংবাদে আসলে বিভাজন বা শ্রেণিভেদ নেই। বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংবাদকে শ্রেণীকরণ করেছেন – কোনোটি পাঠকের প্রয়োজনে, কোনোটি সাংবাদিক-সম্পাদকের সুবিধার্থে। তবে সংবাদ কেবলই সংবাদ।
তথ্যসূত্র - References
- 1গ্রন্থ: সাংবাদিকতা; লেখক: আর রাজী; প্রকাশক: ভাষাচিত্র; প্রকাশকাল: মে, ২০১৬;
- 2গ্রন্থ: সংবাদ : লেখা ও সম্পাদনা; লেখক: সিকান্দার ফয়েজ; প্রকাশনী: বাংলা একাডেমী; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০১;