শুনতে সিনেমার গল্পের মত শোনালেও – জালিয়াতি করে দুই–দুইবার প্যারিসের আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে দিয়েছিলেন ‘ভিক্টর লাস্টিগ’ নামের এক ব্যক্তি। এমনই এক কারসাজির ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশেও।
কাগজে-কলমে দেশের সকল মহাসড়কের মালিক সরকার হলেও রাজধানীর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের একাংশ নিজের নামে মালিকানা জারি করে তা বিক্রিও করে দেয় এক প্রতারক। তারপর ঐ ক্রেতাও আবার সেই জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে পনেরো কোটি টাকা ঋণ নিয়ে চম্পট দেয়।
যমুনা টিভির অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান থ্রি-সিক্সটি ডিগ্রী-র সাংবাদিক দল পঞ্চাশ বছরের ভূমি রেকর্ড বিশ্লেষণ এবং সরকারি নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে এই জালিয়াতির বিস্তারিত জনসম্মুখে সংবাদ আকারে নিয়ে আসে।1ওয়েব পেইজ: সম্পাদকের বাছাই: ২০২১ সালে বাংলাদেশের সেরা অনুসন্ধান; প্রকাশনী: জিআইজেএন বাংলা;
সমাজ ও দেশ-বিদেশের আনাচে-কানাচে ঘটে যাওয়া এমন অসংখ্য ঘটনার সন্ধানে সাংবাদিকরা প্রায়ই সরকারি নথি, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ইত্যাদির সহায়তা নিয়ে থাকেন। পেয়ে যান সাড়া জাগানো বিভিন্ন সংবাদের উৎস ও সূত্র।
সংবাদ উৎস – News Channel
সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিদিন যে শত শত সংবাদ বর্ণনা করা হয়, সেগুলো বানানো গল্প-কাহিনি নয়। বিভিন্ন মাধ্যম মারফত ঘটনা জেনে তার যথার্থতা যাচাই-বাছাই করেই সাংবাদিকরা এসব ঘটনাকে সংবাদে রূপান্তরিত করেন।
গণমাধ্যমগুলো তথা সাংবাদিকরা যেসব মাধ্যম বা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদের সন্ধান এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ও বিবরণ পেয়ে থাকেন, সেগুলোই সংবাদের উৎস (News Channel)।
সংবাদের উৎসসমূহ
গণমাধ্যমের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তাৎক্ষনিক এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে গনমানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। এজন্য গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকরা বিভিন্ন পন্থায় সংবাদের সন্ধান করেন, বিভিন্ন উৎস থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেন। এমনই কিছু সংবাদের উৎস হচ্ছে –
নিজস্ব প্রতিবেদক – Staff Reporter
গণমাধ্যমের প্রধানতম সংবাদ উৎস হচ্ছে নিজস্ব প্রতিবেদক। প্রয়োজনানুসারে জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ে এবং বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমগুলো নিজস্ব প্রতিবেদক নিয়োগ করে থাকে, যারা স্থানীয় বিভিন্ন ঘটনার সংবাদ বিবরণী সংবাদমাধ্যমগুলোকে প্রেরণ করে। যেমন:
“চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলবে ২ নভেম্বর”
প্রথম আলোর এই সংবাদটি তাদের চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে। সেখানে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি না থাকলে হয়তো সংবাদটি তাৎক্ষনিকভাবে জানা যেতো না। আবার, ভিন্ন উৎসে জেনে সপ্তাখানেক পর সংবাদটি প্রকাশ করলে সেটির সময়োপযোগীতা বা সংবাদ মূল্য থাকতো না।
এছাড়া, ক্রীড়া, বিনোদন, আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক বিষয়গুলোর জন্যও গণমাধ্যমের নিজস্ব প্রতিবেদক থাকে, যাদের দায়িত্ব নির্ধারিত বিষয়ের সংবাদ সংগ্রহ ও গণমাধ্যমে প্রেরণ করা। যেমন:
“বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আফগানিস্তানের অঘটন”
সাধারণত, অপেক্ষাকৃত নবীন প্রতিবেদকদের নির্দিষ্ট বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রবীণ প্রতিবেদকগণ এক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করেন, তারা সংবাদের সন্ধানে চষে বেরান অলিগলিতে।2গ্রন্থ: সংবাদ : লেখা ও সম্পাদনা; লেখক: সিকান্দার ফয়েজ; প্রকাশনী: বাংলা একাডেমী; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০১; সংবাদের উৎস নিজস্ব প্রতিবেদক ভিন্ন অন্য কিছু হলেও তারাই গণমাধ্যমের সিংহভাগ সংবাদের রূপকার।
নিজস্ব সংবাদদাতা – Staff Correspondent
মফস্বল এবং গ্রামাঞ্চলে গণমাধ্যমগুলো নিজস্ব সংবাদদাতা নিয়োগ করে থাকে, যারা সেখানকার খবরাখবর গণমাধ্যমের কাছে পৌঁছে দেয়। প্রতিবেদকদের মত সংবাদদাতারা সার্বক্ষণিক সংবাদের সন্ধান করেন না। বরং নিজ অঞ্চলের বিভিন্ন ঘটনার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখেন, সংবাদযোগ্য ঘটনা হলে তা গণমাধ্যমকে অবহিত করেন।
“চিত্রাপারের ‘ওহাবের সন্দেশ’ মন ভোলায় সবার”
প্রথম আলোয় প্রকাশিত এই সংবাদের সারমর্ম হচ্ছে, নড়াইল শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে চিত্রা নদীর তীর ঘেঁষে গোবরা বাজার। সেখানে ওহাব নামের এক ব্যক্তির সন্দেশের দোকান আছে, যা সেখানে খুবই জনপ্রিয়।
এই সংবাদটি স্থানীয় এক সংবাদদাতা প্রেরণ করেছে এবং একজন প্রতিবেদক সংবাদদাতার প্রেরিত তথ্য দিয়ে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন। কিন্তু, একজন প্রতিবেদকের পক্ষে শহর থেকে এত দূরে গিয়ে এধরণের ফিচারমূলক সংবাদ সংগ্রহ বা তৈরি করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। তাছাড়া, জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিংবা বিশেষ কোনো সংবাদ না হলে একজন প্রতিবেদকের জন্য এধরণের সংবাদ সংগ্রহ করাও যৌক্তিক নয়।
উপসম্পাদক বা প্রতিবেদকগণ সংবাদদাতা থেকে ঘটনার বিস্তারিত জেনে এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ ও সংযুক্ত করে তা নিয়ে সংবাদ তৈরি করেন। অবশ্য, অভিজ্ঞ সংবাদদাতারা নিজেরাও সংবাদ বিবরণী করে থাকেন।
সংবাদ সংস্থা – News Agency
গণমাধ্যমগুলোর সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য একটি উৎস হচ্ছে সংবাদ বা বার্তা সংস্থা। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন দেশ ও দূতাবাস, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং স্পর্শকাতর স্থানে প্রবেশে বাঁধানিষেধ থাকে। বিশেষ বিবেচনায় স্বল্প সংখ্যক সাংবাদিককে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হলেও সকল গণমাধ্যমকর্মী তা পান না।
এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের নির্ভরযোগ্য সংবাদ উৎস হচ্ছে সংবাদ সংস্থা। সংবাদ সংস্থাগুলো মূলত বিশেষ বিশেষ স্থানে প্রতিনিধি নিয়োগ করে থাকে, যারা সেসব স্থানে সংবাদ সংগ্রহের কাজটি নির্বিঘ্নে করতে পারেন। পরবর্তীতে গণমাধ্যমগুলো সংবাদ সংস্থা থেকে সেসব সংবাদ সংগ্রহ করে প্রচার করে থাকে।
“নারীরাই যুদ্ধ-সংঘাতের প্রথম শিকার”
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভার এই সংবাদটি প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বার্তা সংস্থা এএফপি থেকে। বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমের পক্ষে অন্যান্য সকল দেশে তৃনমূল পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ সম্ভবপর না। সেক্ষেত্রে ভিনদেশি সংবাদের নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে সংবাদ সংস্থা।
অন্যান্য গণমাধ্যম – Mass Media
গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব তথ্য সংগ্রহ ও পরিবেশন করা। গনমানুষের কাছে প্রয়োজনীয় সংবাদ যথাসময়ে পৌঁছে দিতে তাই গণমাধ্যমগুলো পারস্পারিক নির্ভরশীলতা এবং সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। অন্যান্য গণমাধ্যমের উৎস থেকে সংবাদ এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে।
টেলিভিশনের সরাসরি সংবাদে প্রায়ই দেখা যায়, আকস্মিক কোনো ঘটনার সংবাদ বিবরণীতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া প্রথম সাংবাদিকের বর্ণনা অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোও গ্রহণ ও প্রচার করছে। বিদেশের কোনো সংবাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় পত্রিকাগুলো ভিনদেশি গণমাধ্যমের বর্ণনা অনুবাদ করে ছাপাচ্ছে। যেমন:
“ফিলিস্তিন–ইসরায়েল যুদ্ধের বিস্তার ঠেকাতে আরব রাষ্ট্রগুলো সংকল্পবদ্ধ: অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন”
ফিলিস্তিন–ইসরায়েল যুদ্ধের এই সংবাদটি রয়টার্সের বরাতে প্রথম আলো ছাপিয়েছে। গণমাধ্যমের লক্ষ্যই হচ্ছে সময়োপযোগী সংবাদ প্রচার করে পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন রাখা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মত নাম প্রতিষ্ঠা করা নয়। তাই অন্যান্য গণমাধ্যমও সংবাদের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস।
সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান – Organization & Institution
সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং সভা-সমিতিগুলোও সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সামাজিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক কর্মসূচি, ব্যবসায়ের পরিস্থিতি জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট ঘটনার পূর্বাভাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উৎস হচ্ছে এসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান।
“জনপ্রিয় হচ্ছে হিমায়িত খাদ্যপণ্য”
“বিএনপির পরবর্তী কর্মসূচি ১৮ অক্টোবর”
“প্লাস্টিক সংগ্রহ করবে বিদ্যানন্দের রিক্সা বিন”
এসব সংবাদের উৎস বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। তারা নিজেদের প্রচারণা এবং জনসংযোগের জন্য সংবাদ সম্মেলন, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদির মাধ্যমে গণমাধ্যমকে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত করে। পরবর্তীতে গণমাধ্যম সেগুলো সংবাদ আকারে প্রকাশ করে।
জনসংযোগ বিভাগ – Public Relations Department
ব্যাংক, ব্যবসায়ের মত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আর্থ-সামাজিক সংগঠনের স্বতন্ত্র জনসংযোগ বিভাগ থাকে, যেখান থেকে সেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সংবাদের জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া যায়।
কৌশলী হলে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের জন্য এটি অন্যতম সংবাদ উৎস হতে পারে। তবে, এই উৎসে প্রাপ্ত তথ্যাদি অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হয়। কারণ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের স্বার্থে প্রায়ই আংশিক এবং অসত্য তথ্য প্রদান করে।
সংবাদ সম্মেলন ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি – Press Briefing & Press Release
রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বাণিজ্যিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন বিষয় ও পরিস্থিতি নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করে। এসব অনুষ্ঠানে সংগঠনের মতামত, কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। কখনো কখনো তারা গণমাধ্যমের কাছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও প্রেরণ করে।
আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণও ঘটনার ভুক্তভোগী হয়ে সংবাদ সম্মেলন করে থাকে। ব্যক্তি বা সংগঠন, যাই হোক না কেন, সংবাদ সম্মেলন এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সূত্র ধরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের সন্ধান মেলে। তাই এগুলোও সংবাদের উৎস।
সরকারি নথি ও প্রতিষ্ঠান – Govt. Documents & Institution
সরকারি নথি এবং প্রতিষ্ঠান সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। সরকারি বিভিন্ন নথি ঘেঁটে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা অনেক আলোচিত-সমালোচিত নানান ঘটনার রহস্য উদ্ঘাতন করেছেন। গনমানুষের মুখপত্র হিসেবে সরকারের সাথে লড়াই করে সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
“রাজউক থেকে ৩০ হাজার গ্রাহকের নথি গায়েব”
ঘটনার পর অনলাইনে রাজউকের কিছু কার্যক্রম প্রায় মাসখানেক যাবত বন্ধ ছিল। প্রথম আলোর এই সংবাদের প্রেক্ষিতে ঘটনাটি বিশেষ গুরুত্ব পায়, হাইকোর্ট থেকেও আদেশ-নির্দেশনা দেয়া হয়। গনমানুষের ভোগান্তি কিছুটা লাঘব হয়।
নাগরিকদের অধিকার ও সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতেও সচিবালয়, মন্ত্রণালয়, পৌরসভা, দপ্তর, কার্যালয়ের মত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস হিসেবে কাজ করে।
প্রেস নোট – Press Note
নাগরিক সচেতনতা ও অবগতি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর বা সচিবালয় থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি, নির্দেশনা প্রচারের জন্য পাঠানো হয়। গণমাধ্যমগুলো প্রচারের পাশাপাশি বিষয়টির নিগূঢ় রহস্য ও কারণ খুঁজতে গিয়েও সংবাদের সন্ধান পেয়ে যান। যেমন:
“বিজ্ঞপ্তি দিয়েও বিজ্ঞানী খুঁজে পাচ্ছে না সরকারি প্রতিষ্ঠান”
২০২২ সালের জুলাই মাসে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এর প্রায় ৪ মাস পরও প্রতিষ্ঠানটি সেই পদে কাউকে নিয়োগ দিতে পারে নি।
প্রথম আলো সেই বিজ্ঞপ্তি ধরে অনুসন্ধান করে জানতে পারে, এই পদের জন্য যোগ্য আবেদনকারীই পায় নি সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কোথা বলে জানা যায়, এই পদের যোগ্য প্রার্থীদের অধিকাংশই বিদেশে বিভিন্ন সংস্থায় উচ্চবেতনে চাকরি করে। গবেষণার সুযোগের অভাবে তারা দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে অনাগ্রহী।
সেই সরকারি বিজ্ঞপ্তির সূত্র ধরেই প্রথম আলো এই সংবাদটি ছাপিয়েছে। এভাবেই সরকারি বিজ্ঞপ্তি, প্রেস নোট সংবাদের উৎস হয়।
থানা ও আদালত – Police Station & Court
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দুর্ঘটনা, বিরোধপূর্ণ ঘটনার বিবরণ জানতে নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে পুলিশ স্টেশন বা থানা এবং আদালত। ছোটখাটো চুরি, জিনিস হারানো থেকে শুরু করে সংঘর্ষ, খুনখারাপি – সব ঘটনার বিস্তারিত লিখিত বিবরণ থানায় জমা থাকে।
এসব ঘটনা মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ালে ঘটনার বাদী, বিবাদী, সাক্ষী, আইনজীবী, বিচারক – সকলের ভাষ্য এবং তদন্ত প্রতিবেদন, রায় ইত্যাদি আদালতে সংরক্ষণ করা হয়। থানা ও আদালতের এসব নথি সংবাদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহের অন্যতম উৎস।
হাসপাতাল ও হোটেল – Hospital & Hotel
হাসপাতাল এবং ক্লিনিক থেকে অনেক সময় সংবাদের তথ্য পাওয়া যায়। আকস্মিক ঘটনা যেমন- সড়ক কিংবা অগ্নি দুর্ঘটনায় হতাহত, পারিবারিক কিংবা সামাজিক কলহ-বিবাদে আহত বা নির্যাতিত, বিশেষ ব্যক্তির শারীরিক উন্নতি কিংবা অবনতি, কারো জন্ম বা মৃত্যু ইত্যাদির সংবাদ হাসপাতালে পাওয়া যায়।
“কক্সবাজারে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে রেস্টুরেন্ট মালিকের বিরুদ্ধে মামলা”
কক্সবাজারের পর্যটন এলাকা কলাতলীতে অবস্থিত শালিক রেস্টুরেন্টের মালিকের বিরুদ্ধে নারী কর্মচারীদের যৌন নিপীড়ন ও মারধরের অভিযোগে উঠেছে।কক্সবাজার দেশ ও দেশের বাহিরের পর্যটকদদের বন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কর্মচারীকে মারধরের ঘটনাটি হোটেলের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং জনমনে এই ঘটনার গুরুত্বও ব্যাপক।
হোটেল, মোটেল, রিসোর্টসহ হাসপাতালও সংবাদের উৎস হতে পারে। দেখা গেল মারামারিতে আহতের পর দুই পক্ষই একই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে হাসপাতালেই পুনরায় সংঘর্ষে জড়াল তখন হাসাপাতাল একটি সংবাদ উৎস। এই উৎস থেকে অনেক সময় চাঞ্চল্যকর সংবাদ পাওয়া যায়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান – Research Institute
দেশ-বিদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও সংবাদের নির্ভরযোগ্য উৎস। আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো মাঠপর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সেসব তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তীতে গবেষণা প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়।
“বিদেশ থেকে লাশ হয়ে আসা নারীদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী: রামরুর গবেষণা”
প্রথম আলোয় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে করা হয়েছে। মানসম্মত এবং নির্ভরযোগ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান গণমাধ্যমের সাধারণত তেমন যাচাই করতে হয় না। তবে এসব প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে বিভিন্ন সংবাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
উপরিউক্ত গবেষণার একাংশে বলা হয়েছে, “৩১ শতাংশ নারী শ্রমিকের অস্বাভাবিক (দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা) মৃত্যু হয়েছে।…কিন্তু লাশ পাওয়া পরিবারগুলোর ৪৮ শতাংশই মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।” অর্থাৎ কিছু শ্রমিকের মৃত্যু স্বাভাবিক বলা হলেও পরিবারগুলো অস্বাভাবিক মৃত্যুর দাবি করেছে। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের সন্ধান পেতে পারে।
সংবাদ সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের সৃজনশীল প্রতিভায় রচিত কল্পগল্প নয়। সমাজের নিত্যদিনের বাস্তব ঘটনাবলি বস্তুনিষ্ঠভাবে বর্ণনাই সংবাদ। এই ঘটনাগুলো ঘটে সমাজস্থ প্রতিষ্ঠান, সংগঠনকে কেন্দ্র করে। পাঠক-দর্শকের প্রয়োজনে, সময়োপযোগীতা রক্ষার্থে সমাজস্থ এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘সংবাদের উৎস’ হিসেবে – যেখানে সংবাদযোগ্য ঘটনার সন্ধান মেলে।
সংবাদ উৎস বনাম সংবাদ সূত্র – News Channel vs News Source
অনেকে সংবাদ উৎস এবং সংবাদ সূত্রকে সমার্থক ভেবে থাকেন।প্রকৃতপক্ষে, এই পরিভাষাগুলো খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ কিন্তু সমার্থক নয়।
সহজ ভাষায় বললে, সংবাদ উৎস হচ্ছে সংবাদ প্রাপ্তির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, স্থান কিংবা ব্যক্তিত্ব, যারা সংবাদের পরিপূর্ণ কাঠামো তৈরিতে সহায়তা করেন। অর্থাৎ, একজন সাংবাদিক সংবাদ উৎস থেকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারেন, পরবর্তীতে সেই বিবরণকে সংবাদ প্রতিবেদনে রূপান্তরিত করেন।
অপরদিকে, সংবাদ সূত্র হলো ঐ প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, স্থান কিংবা ব্যক্তিত্বদের সংশ্লিষ্ট বা অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যক্তি, যিনি বা যারা প্রাথমিকভাবে সাংবাদিককে ঘটনা সম্পর্কে অবগত করেন কিংবা সংবাদ উৎস হতে প্রাপ্ত বিবরণ থেকে আরো সুনির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে পেতে সহায়তা করেন।
উদাহরণস্বরূপ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়, যা সংবাদ উৎস। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কখনোই কিছু বলা হয় না। একজন সাংবাদিকের পক্ষেও এসব প্রতিষ্ঠানের অফিসে গিয়ে নথিপত্র ঘেঁটে সেসব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ বের করা দুরূহ।
সেক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকের পরিচিত কোনো কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও প্রমাণ সরবরাহের মাধ্যমে সংবাদ সূত্রের ভূমিকা পালন করেন।
তথ্যসূত্র - References
- 1ওয়েব পেইজ: সম্পাদকের বাছাই: ২০২১ সালে বাংলাদেশের সেরা অনুসন্ধান; প্রকাশনী: জিআইজেএন বাংলা;
- 2গ্রন্থ: সংবাদ : লেখা ও সম্পাদনা; লেখক: সিকান্দার ফয়েজ; প্রকাশনী: বাংলা একাডেমী; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০১;