বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই পণ্যটি যাচাই করি। মাছ-মাংস বা তরকারি হলে দেখি সেগুলো তাজা কিনা, প্যাকেটজাত পণ্যের পরিমাণ বা আকার এবং প্রসাধনীর ক্ষেত্রে দেখি সেগুলোর গুণাগুণ। যেই পণ্য যত তরতাজা, যত বেশি গুণাগুণ সমৃদ্ধ, আমরা সেই পণ্যটিই কিনে থাকি।
সংবাদও একধরনের পণ্য। পাঠক, দর্শক, শ্রোতারা তরতাজা এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনার সংবাদগুলো পড়তে, দেখতে কিংবা শুনতেই বেশি আগ্রহী হয়।
প্রতিদিন আমাদের চারপাশে ঘটে হাজারো ঘটনা, তা থেকে বাছাই করে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় মাত্র শ’খানেক সংবাদ। তবুও সব সংবাদ সবাই পড়ে না। তবে যেসব সংবাদের কিছু বিশেষ গুণাগুণ থাকে, সেগুলো সবাই পড়ে। সাংবাদিকতার পরিভাষায় সেসব গুণাবলিকে বলা হয় ‘সংবাদ মূল্য’।
সংবাদ মূল্য – News Value
গণমাধ্যম গনমানুষের সার্বক্ষণিক সহচর। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে যথাযথ তথ্য জানানোই গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য। তাই গনমানুষের আগ্রহ, প্রয়োজন বিবেচনায় রেখেই গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করে। যে সংবাদ পাঠক-দর্শকের প্রয়োজন যত বেশি পূরণ করে, সে সংবাদ পড়তে, দেখতে কিংবা শুনতে তারা তত বেশি আগ্রহী হয়। আর যে সংবাদের প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ যত বেশি, সে সংবাদের মূল্য তত বেশি।
অর্থাৎ, সংবাদের যেসব বৈশিষ্ট্য পাঠক, দর্শক, শ্রোতাদের সংবাদের প্রতি আকৃষ্ট করে, তা-ই সংবাদ মূল্য। ইংরেজিতে একে News Value বা News Worthiness বলা হয়।
সংবাদ মূল্য কেবল পাঠক, দর্শক, শ্রোতাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এমন নয়। সংবাদকে গনমানুষের কাছে প্রয়োজনীয়, আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলাতেই গণমাধ্যমের সার্থকতা। যেসব সংবাদ পাঠক-দর্শকরা গ্রহণ করে না, সেসব সংবাদের মূল্য নেই। এজন্য সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমগুলোকেও সংবাদ মূল্য বজায় রেখেই সংবাদ প্রকাশ করতে হয়।
একজন সাংবাদিক, যিনি হয়তো একটি পত্রিকায় উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন, তার উপজেলায় প্রতিদিন হাজারো ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন: স্থানীয় নির্বাচন, খরায় ফসলের ক্ষতি এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধার। একজন সাংবাদিকের পক্ষে একই দিনে সশরীরে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি ঘটনার বিস্তারিত জেনে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তৈরি কষ্টসাধ্য।
এক্ষেত্রে সাংবাদিকের উচিত স্থানীয় নির্বাচনের সংবাদকেই গুরুত্ব দেয়া। কারণ, খরা দীর্ঘ সময় যাবত চলবে, দিনকয়েক পরও তা নিয়ে সংবাদ করা যাবে। অন্যদিকে, অপর দুটি সংবাদের তুলনায় মাদকদ্রব্য উদ্ধারের সংবাদের গুরুত্ব কম। তাই আপাতত এই সংবাদটি এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল বা সর্বশেষ পরিস্থিতি কিছুদিন পর জানালে সংবাদটির কোনো মূল্য থাকবে না।
তাছাড়া, সংবাদ মূল্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা না থাকলে সাংবাদিকের পক্ষে সঠিক সংবাদ নির্বাচন করা অসম্ভব। সাংবাদিকও একজন মানুষ। তিনি হয়তো তার কৌতূহলের জায়গা থেকে প্রথম দুটি ঘটনা বাদ দিয়ে মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে সংবাদ লিখে বসবেন। ফলে অধিকাংশ পাঠক, দর্শক সেই সংবাদটি নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
কোনো কারণে যদি সাংবাদিক তিনটি সংবাদই প্রচারের জন্য সম্পাদকের কাছে পাঠায়, সেক্ষেত্রেও তিনটি সংবাদই ছাপানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ, কাগজের পত্রিকায় কেবল এক উপজেলা নিয়েই তিনটি সংবাদের স্থান সংকুলান করে ছাপানো কিংবা টেলিভিশনের সংবাদ অনুষ্ঠানে নির্ধারিত সময়সীমার মাঝে প্রচার করা সম্ভব নয়।
আবার ধরণ ও নীতিমালার জন্যও সব গণমাধ্যম সব সংবাদ ছাপায় না। যেমন: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল, পরিবেশ-প্রকৃতি, বিজ্ঞান ঘিরে যাদের কর্মকাণ্ড, তারা খরায় ফসলের ক্ষতি সংক্রান্ত সংবাদ করবে। কেননা, তাদের ধরণ বা নীতিমালার সাথে এই সংবাদটির মূল্যমান প্রাসঙ্গিক এবং দর্শকবৃন্দও এধরনের সংবাদ জানার আগ্রহ থেকেই চ্যানেলটি দেখে।
তাই, সংবাদ সংগ্রহ, লিখন এবং সম্পাদনার ক্ষেত্রে সাংবাদিক এবং সম্পাদকদের অবশ্যই সংবাদ মূল্য যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে।
সংবাদ মূল্য নির্ধারক – News Value Determining Factors
মানুষ তথা পাঠক, দর্শক, শ্রোতার স্বার্থ, আগ্রহ-আকর্ষণই মূলত সংবাদ মূল্য নির্ণায়ক। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় কিছু বৈশিষ্ট্যকে সংবাদ মূল্য নির্ধারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সংবাদে যেগুলোর উপস্থিতি থাকা আবশ্যক।
প্রধানত চারটি বৈশিষ্ট্য বা শর্ত (Factor) সংবাদ মূল্য নির্ধারণ করে থাকে।1গ্রন্থ: সংবাদ : লেখা ও সম্পাদনা; লেখক: সিকান্দার ফয়েজ; প্রকাশনী: বাংলা একাডেমী; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০১ সেগুলো হচ্ছে –
- সময়োপযোগিতা – Timeliness
- নৈকট্যতা – Proximity
- আকার – Size
- গুরুত্ব – Importance
১. সময়োপযোগিতা – Timeliness
সংবাদ মূল্য নির্ধারণে প্রধানতম শর্ত হচ্ছে সংবাদের সময়োপযোগিতা বা তাৎক্ষণিকতা। বলা হয়ে থাকে সংবাদ একটি পচনশীল দ্রব্য। সময় যত গড়ায়, সংবাদ তত বাসি হয়। তাই তাৎক্ষনিকভাবে উপস্থাপন করা না হলে সংবাদের মূল্য থাকে না কিংবা কমে যায়।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কল্যাণে বিশ্বের অন্য প্রান্তের সংবাদও মিনিটের মধ্যেই ভিডিওসহ দেখা যায়। নেটিজেনরাও তাৎক্ষনিক সংবাদের জন্য এসব মাধ্যমে ভরসা করে। তারই ধারাবাহিকতায় টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টাল এবং সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর নিউজ পেইজগুলো “সর্বশেষ”, “এই মাত্র পাওয়া”, “লাইভ” ইত্যাদি শিরোনামে তাৎক্ষনিকভাবে সংবাদ প্রচারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
কাগজের পত্রিকাও আগের দিনের ঘটনাগুলো নিয়েই সংবাদ সাজায় – কয়েকদিন আগের সংবাদ ছাপায় না, ছাপালেও সেগুলো থাকে ভিতরের পাতায় ছোট্ট করে এক কোণায়।
এর কারণ “সময়োপযোগিতা” বা সংবাদ মূল্য ধরে রাখা। সময়মত যথাযথ সংবাদ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে একদিকে পাঠক, দর্শকদের সংবাদের আগ্রহ থাকে না। অপরদিকে গণমাধ্যম পাঠক, দর্শক হারিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
কর্পোরেট মিডিয়ার এই যুগে গণমাধ্যমগুলো গনমানুষের কাছে সংবাদ বিক্রি করে – কখনো সরাসরি, কখনো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। ফলে তাৎক্ষনিকভাবে সংবাদ প্রকাশে ব্যর্থ হলে পাঠক, দর্শক কমে যায়, তারা অন্য গণমাধ্যম অনুসরণ করতে শুরু করে। যেমন –
“রবিবার হরতাল ডাকল বিএনপি”
এই সংবাদের ক্ষেত্রে ধরে নেয়া যাক, শুক্রবার তথা আগের দিনই বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনাটি জানানো হয়েছে। কিছু টেলিভিশন সংবাদ সম্মেলনটি লাইভ সম্প্রচার করেছে। কিন্তু কোনো টেলিভিশন যদি তাৎক্ষনিক সেই সংবাদ প্রচার না করে সোমবার “গতকাল বিএনপির ডাকা হরতাল পালিত হয়েছে” শিরোনামে সংবাদ উপস্থাপন করে, ইতোমধ্যেই অন্য টেলিভিশনে সংবাদটি দেখা দর্শকরা পুনরায় তা দেখবে না। কারণ তখন সংবাদটির সময়োপযোগিতা বা সংবাদ মূল্য নেই।
এমনকি সকল গণমাধ্যমই যদি সংবাদটি সোমবার প্রকাশ করে, তাহলেও সংবাদের মূল্য কমে যাবে। সংবাদটি শনিবার জানা গেলেও যাদের কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, তারা বিকল্প ব্যবস্থা করে রাখতে পারতো। কিন্তু সোমবার সংবাদটি জানলে দর্শকদের সেই সুযোগ থাকবে না। ফলে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিবে। সময়োপযোগিতার অভাবে সংবাদটির মূল্য বিলীন হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, তাৎক্ষণিকতাই সর্বদা সময়োপযোগিতা নয়। ঘটনার পিছনের ঘটনা অনেক সময় তাৎক্ষনিকভাবে নাও জানা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পাঠক, দর্শকের আগ্রহ বিবেচনায় সংবাদ মূল্য থাকলে দীর্ঘ সময় পরেও কোন ঘটনার সংবাদ প্রচারিত হতে পারে।
২. নৈকট্য – Proximity
নৈকট্য সংবাদ মূল্য নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। নিজস্ব পরিমণ্ডলের খবরাখবর মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করে। বাসার পাশে রিক্সার টায়ার বিস্ফোরণ হলেও আমরা জানালায় উঁকি দিয়ে দেখি কি ঘটলো। কিন্তু ভিন দেশে বড়সড় বোমা বিস্ফোরণের সংবাদ দেখার সময় আমরা বসা থেকেও উঠি না! নিকটবর্তী ক্ষুদ্র একটি ঘটনাও পাঠক, দর্শককে দূরবর্তী বৃহৎ ঘটনার চেয়ে বেশি আগ্রহী, কৌতূহলী করে তোলে। যেমন:
“সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৫০”
“ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ২ হাজার ওয়াগনার যোদ্ধা হতাহত”
প্রথম ঘটনাটি রাজধানী ঢাকায়, দ্বিতীয়টি সুদূর ইউক্রেন-রাশিয়ার। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে প্রথম ঘটনাটি। দেশের মানুষ ক্রমাগত সিদ্দিকবাজারের দুর্ঘটনার সর্বশেষ সংবাদ জানতে টেলিভিশনে চোখ রাখবে। সেই তুলনায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দিকে তাদের তেমন নজর থাকবে না।
অথচ সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে আঠারো জন, যেখানে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মাত্র একাংশেই নিহতের সংখ্যা ত্রিশ হাজার! সিদ্দিকবাজারের ঘটনার প্রতি দেশের পাঠক, দর্শকদের এই আগ্রহের পিছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে নৈকট্য।
নৈকট্য কেবল ভৌগলিক ব্যাপার না, মানসিক নৈকট্যও সংবাদ মূল্য নির্ধারণে অনুঘটক। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে কোনো বাংলাদেশী হতাহত হলে কিংবা কোনভাবে বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত কিছু ঘটলে, সেই সংবাদের মূল্য বেড়ে যাবে। যেমন –
“ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে আটকা পড়েছে দুই বাংলাদেশি জাহাজ”
এই ঘটনাটিও সুদূর ইউক্রেন-রাশিয়ার কিন্তু ভুক্তভোগীরা বাংলাদেশী। জাহাজ দুটি এবং এতে আটকে পড়া মানুষজন যেহেতু বাংলাদেশী, দেশের মানুষজন এই ঘটনা জানতে অধীর আগ্রহে ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইবে। দেশীয় গণমাধ্যমও এই সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রচার করবে। এর কারণ, মনস্তাত্ত্বিক নৈকট্য – ভুক্তভোগীদের সাথে তাদের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, সর্বোপরি দেশের মানুষের মানসিক নৈকট্য সংবাদটির মূল্যমানের ভিত্তি।
এভাবেই নৈকট্য পাঠক, দর্শক, শ্রোতাদের সংবাদের প্রতি আকৃষ্ট করে, সংবাদের মূল্য নির্ধারণ করে। তাই স্থানীয় গণমাধ্যমে স্থানীয় সংবাদকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। ২০ পৃষ্ঠার একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার প্রায় ১৫/১৬ পৃষ্ঠা জুড়েই থাকে কেবল স্থানীয় সংবাদ, একটি টেলিভিশনে ৩০ মিনিটের সংবাদ অনুষ্ঠান প্রচারিত হলে তার হয়তো ২০ মিনিট যাবত প্রচারিত হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনার সংবাদ। কেননা অন্য যেকোনো বৈশিষ্ট্যের চেয়ে নৈকট্য পাঠক, দর্শক, শ্রোতাদের মাঝে অধিক আবেদন, আগ্রহ সৃষ্টি করে।
৩. গুরুত্ব – Importance
গুরুত্ব বা তাৎপর্য সংবাদ মূল্য নির্ধারণের অন্যতম চাবিকাঠি। পাঠক সমাজে যেসব ঘটনার গুরুত্ব যত বেশি, যে ঘটনা যত বেশি মানুষকে সম্পৃক্ত করে, সেই সংবাদের মূল্যও তত বেশি। যেসব ঘটনা মানুষকে তথ্য দেয়, সতর্ক করে, অনুপ্রেরণা যোগায়, বিনোদন দেয়, আবেগাপ্লুত করে, সেসবই সংবাদযোগ্য ঘটনা। জনস্বার্থবিহীন কোনো ঘটনা কখনো সংবাদ হয় না। যেমন:
“কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ”
এই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন রাষ্ট্রপতির মত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ কর্মকাণ্ডও গনমানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায়, তাঁদের কর্মকাণ্ড নিয়ে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনা থাকে। তাই এই ঘটনাটি সংবাদে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মিঠামইনে প্রতিদিন ঘুরতে যাওয়া হাজারো দর্শনার্থীদের নিয়ে সংবাদ হয় না। কারণ, সাধারণ কারোর কোথাও ঘুরতে যাওয়া নিয়ে পাঠক, দর্শকদের তেমন আগ্রহ নেই, সেসব জনস্বার্থ বা গণআগ্রহপূর্ণ কোনো ঘটনাও নয়।
সাংবাদিক ও সম্পাদকদের জন্যও গুরুত্ব সংবাদ মূল্য নির্ধারণের মাপকাঠি। গুরুত্বের ভিত্তিতেই সংবাদ বিবরণী সাজানো হয়, সংবাদের স্থান নির্ধারণ করা হয়। কাগজের পত্রিকার প্রচ্ছদ তথা প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা সাজানো হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো দিয়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি হয় “প্রধান সংবাদ” বা “Lead News”, ছাপানো হয় প্রথম পাতায় সবচেয়ে বড় এবং আকর্ষণীয় করে। সংবাদটির বিবরণীও হয় বিস্তারিত। পক্ষান্তরে কম গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো ছাপানো হয় ভিতরের পাতায়, সংক্ষিপ্ত বিবরণেই সেসব সংবাদ সমাপ্ত হয়।
টেলিভিশনেও সংবাদ অনুষ্ঠানের একদম শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো দিয়ে সাজানো হয় “প্রধান শিরোনাম” বা “এক নজরে” অংশ, যেখানে কম গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো স্থান পায় না। তারপর বিস্তারিত সংবাদ উপস্থাপনের অংশেও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো নিয়ে সচিত্র এবং বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়, অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো উপস্থাপন করা হয় অনুষ্ঠানের শেষদিকে, তাও সংক্ষিপ্তাকারে।
প্রকৃতপক্ষে, গুরুত্ব হচ্ছে পরশ পাথর, যার ছোঁয়ায় একটি ঘটনা সংবাদে পরিণত হয়। গুরুত্বের কারণেই কোনো ঘটনা বাড়তি প্রাধান্য পায়, কোনো ঘটনা পায় স্বল্প, আবার কোনো কোনো ঘটনা সংবাদ উপযোগিতাই পায় না।
৪. আকার – Size
আকার সংবাদ মূল্য নির্ণয়ের অন্যতম পরিমাপক। মানুষ স্বভাবতই কৌতূহলী। বৃহত্তম বা ক্ষুদ্রতম, সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন, কনিষ্ঠতম বা জ্যেষ্ঠতম, আধিক্য বা অভাব ইত্যাদি পরিমাণ, সংখ্যা, আকৃতি সম্পর্কিত সংবাদের প্রতি পাঠক, দর্শকের বিপুল আগ্রহ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং ছোট দেশ, সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা কিংবা সবচেয়ে নিচু স্থান, সবচেয়ে কম বয়সী এবং বয়স্ক খেলোয়াড় – মানুষ এসব জানতে উৎসুক। তাই এধরনের ঘটনা নিয়ে প্রায়ই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়। যেমন –
“২৪ বার এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড গড়লেন রিতা”
“পদ্মা সেতু: দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম দ্বিতল সেতু”
“কনিষ্ঠতম আন্তর্জাতিক মাস্টার হওয়ার পথে দাবাড়ু ফাহাদ”
উল্লেখ্য, আধিক্য বা স্বল্পতা – সবসময় মুখ্য নয়। ব্যাপকতাও ক্ষেত্রবিশেষে সংবাদ মূল্য নির্ধারণ করে। বৃহৎ সংগঠনগুলোর সমাবেশে প্রায়শই কয়েক লক্ষ লোকের জমায়েত হয়, যেখানে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনের সভা-সমাবেশে সাধারণত শত বা হাজার খানেক লোক হয়। কিন্তু লক্ষাধিক লোকের সমাগমের ঘটনা ঘটলে তা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। যদিও তা সর্বাধিক লোকসমাগমের ঘটনা নয়।
ভিত্তিহীন ও অপ্রাসঙ্গিক সংবাদ এবং ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টালের এই যুগে গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা রক্ষার্থে সংবাদ মূল্য বজায় রাখা খুবই জরুরি। বিখ্যাত লেখক ও গবেষক থমাস লরেন্সের ভাষ্যমতে, “সংবাদ মূল্য বজায় রাখা কারো লেজে টিনের কৌটা বেঁধে দেয়ার মত।”2গ্রন্থ: The Letters of T.E. Lawrence; সম্পাদক: Malcolm Brown; প্রকাশকাল: ১৯৩৮ তবে কঠিন এই কাজটিই পেশাগত সাংবাদিকতার ভিত্তিকে দৃঢ় করেছে।
সংবাদ মূল্য বনাম সংবাদের উপাদান
সংবাদ মূল্য বা সংবাদ মূল্য নির্ধারক শর্তাবলির সাথে প্রায়ই সংবাদের উপাদানকে গুলিয়ে ফেলা হয়। সংবাদ মূল্য নির্ধারক বিষয়াবলিও সংবাদের উপাদান হওয়ায় এমনটি ঘটে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে, উপাদান একটি ঘটনাকে সংবাদযোগ্য করে তোলে। কিন্তু “সংবাদ-উপাদান কোনো অবস্থাতেই সংবাদের মূল্য নির্ধারণ করে না তবে একটি ঘটনায় সংবাদ-উপাদানের সংখ্যাধিক্য সংবাদটির গুরুত্ব বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।”3গ্রন্থ: সাংবাদিকতা; লেখক: আর রাজী; প্রকাশনী: ভাষাচিত্র; প্রকাশকাল: মে, ২০১৬
মূলত, সংবাদ মূল্য সংবাদের প্রকাশযোগ্যতা নির্ধারণ করে। একটি সংবাদ প্রকাশিত বা উপস্থাপিত হবে কি না, তা নির্ধারণ করা হয় সংবাদটির মূল্য বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে। পক্ষান্তরে সংবাদের উপাদান হচ্ছে সংবাদের খোরাক, যা একটি ঘটনা প্রাথমিকভাবে সংবাদযোগ্য ঘটনা বলে বিবেচিত হবে কি না, তা নির্ধারণ করে।
মানদণ্ডের বিচারে, উপাদান হচ্ছে সংবাদের প্রাথমিক মানদণ্ড, যা একজন সাংবাদিককে বিভিন্ন ঘটনা থেকে সংবাদযোগ্য ঘটনাগুলো খুঁজে পেতে সহায়তা করে। তারপর, নির্বাচিত সেসব ঘটনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো বেঁছে নিয়ে প্রয়োজন অনুসারে সংবাদ বিবরণী সাজাতে সাংবাদিককে সহায়তা করে সংবাদ মূল্য।
পরবর্তী ধাপে, সম্পাদক ও উপ-সম্পাদকগণ সময়োপযোগিতা, নৈকট্য, গুরুত্ব এবং আকার যাচাই-বাছাই করে সংবাদটির মূল্যমান নির্ধারণ করেন। এই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হলেই সংবাদটি প্রকাশ করা হয়। একটি সংবাদ পত্রিকার কোন পাতার কোন স্থানে কিংবা টেলিভিশনের সংবাদ অনুষ্ঠানের কোন অংশে প্রচারিত হবে, তাও নির্ধারণ করে সংবাদ মূল্য।
তথ্যসূত্র - References
- 1গ্রন্থ: সংবাদ : লেখা ও সম্পাদনা; লেখক: সিকান্দার ফয়েজ; প্রকাশনী: বাংলা একাডেমী; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০১
- 2গ্রন্থ: The Letters of T.E. Lawrence; সম্পাদক: Malcolm Brown; প্রকাশকাল: ১৯৩৮
- 3গ্রন্থ: সাংবাদিকতা; লেখক: আর রাজী; প্রকাশনী: ভাষাচিত্র; প্রকাশকাল: মে, ২০১৬