১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পরে ফ্রান্সে শিল্পায়নের দ্রুত বিস্তার ঘটে। উন্নত জীবন এবং অধিক উপার্জনের আশায় এসময় গ্রামাঞ্চলের মানুষজন শহরমুখী হয়। চাষাবাদ ছেড়ে শিল্প-কারখানায় চাকরিকে তারা পেশা হিসেবে বেছে নেয়।
সেই শ্রমিকদের আয় গ্রামীণ কৃষকদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি হলেও জীবনমান খুব একটা উন্নত হয় নি। ফলশ্রুতিতে উদ্ভব ঘটে মধ্যবিত্ত শ্রেণির, যারা সমৃদ্ধির আশায় প্রতিনিয়ত রুদ্ধশ্বাস সংগ্রামে শহুরে জীবনকে আকড়ে ধরে থাকে। পরিবারের সকলে কঠিন পরিশ্রম করলেও তাদের সংসারে টানাপোড়েন দূর হয় না।
১৮২৯ সালে বিষয়গুলো, বিশেষত পারিবারিক বাজেট বা অর্থনীতি সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক লা প্লে কেস স্টাডির প্রয়োগ করেন। ধারণা করা হয়, এই গবেষণার মাধ্যমেই কেস স্টাডি পদ্ধতির প্রচলন ঘটে।
পরবর্তীতে বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার, ড. উইলিয়াম হিলি, পি. ভি. ইয়ং প্রমুখ কেস স্টাডি পদ্ধতিকে স্বীকৃতি এবং ব্যাবহার করতে শুরু করলে অন্যান্য বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাছেও এটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।
সামাজিক গবেষণায় এই পদ্ধতির প্রয়োগ খুবই জনপ্রিয়। গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিষয়বস্তু সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং কারণ উদ্ঘাটনের প্রয়োজন হলে গবেষকগণ কেস স্টাডি পদ্ধতির প্রয়োগ করেন, যেখানে দু’য়েকটি ঘটনার একদম খুঁটিনাটি সহ জানার মাধ্যমে বৃহৎ কোনো ঘটনা সামগ্রিকভাবে জানার চেষ্টা করা হয়।
কেস স্টাডি – Case Study
কেস স্টাডি হচ্ছে কোনো সামাজিক একক বা অবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান ও বিশ্লেষণের পদ্ধতি। এ পদ্ধতিকে বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
সমাজবিজ্ঞানী পি. ভি. ইয়ং-র ভাষ্যমতে, “কেস স্টাডি হচ্ছে সমাজের কোনো এক অংশ নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক অধ্যয়ন। উক্ত অংশটি একজন ব্যক্তি, একাধিক ব্যক্তির সমন্বিত দল, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি গোষ্ঠী কিংবা একটি পরিবারও হতে পারে।”1গ্রন্থ: Research Methodology and Fieldwork; সংস্করণ: ; লেখক: Pauline V. Young; প্রকাশক: e-PG Pathshala INFLIBNET Centre; প্রকাশকাল: 1966; উদ্ধৃতি: “Case study is a comprehensive study of a social unit, be it a person, a group of persons, an institution, a community or a family.”
উইলিয়াম গুডি এবং পল হ্যাট কেস স্টাডি পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, “এটা সামাজিক তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি যাতে গবেষণাধীন সামাজিক বিষয়ের একক বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে।” কিছুটা ভিন্ন ভাবে বললে, “এটা এমন একটি পদ্ধতি যা কোনো সামাজিক একককে সামগ্রিকভাবে দেখে।”2 গ্রন্থ: Methods in Social Research; সংস্করণ: ; লেখক: William Josiah Goode, Paul K. Hatt; প্রকাশক: Mcgraw-Hil; প্রকাশকাল: 1981; উদ্ধৃতি:
The Social Work Dictionary-তে কেস স্টাডি পদ্ধতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে, “সাধারণত দীর্ঘ সময়ব্যাপী কোনো একজন ব্যক্তি, গ্রুপ, পরিবার অথবা সম্প্রদায়ের হয়ে বৈশিষ্ট্য নিয়মমাফিক ভাবে পরীক্ষা করার মাধ্যমে মূল্যায়ন করার একটি পদ্ধতি।”
ড. হ্যানস রাজ লিখেছেন, “ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়ের মত সামাজিক এককগুলোর কোনোটির জীবনধারা উন্মোচন ও বিশ্লেষণের পদ্ধতি হচ্ছে কেস স্টাডি।”3 গ্রন্থ: Theory and Practice in Social Research; সংস্করণ: ৩য় (পরিমার্জিত); লেখক: Dr. Hans Raj; প্রকাশক: Surjeet Publications; প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০১৮; উদ্ধৃতি: “The method of exploring and analysing the life of a social unit be that a person, a family or an institution, or a community be called case study.”
সর্বোপরি, কেস স্টাডি এক বা স্বল্পসংখ্যক ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এ পদ্ধতিতে সাধারণত অনুসন্ধানেয় চলকসমূহের ধরন ও পরিবেশন এর উপর আলোকপাত করা হয় এবং এই উপায় সর্বাত্মক ও গভীরতর অনুসন্ধানমুখী হয়ে থাকে।
কেস স্টাডির উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্য – Purpose & Nature of Case Study
কেস স্টাডি পদ্ধতির কতিপয় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যেগুলো এ পদ্ধতিকে সামাজিক গবেষণায় ব্যবহৃত অন্যান্য পদ্ধতি থেকে পৃথক করেছে। এ পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল:
একক ঘটনা বিশ্লেষণ পদ্ধতি
কেস স্টাডি পদ্ধতিতে এক বা খুবই মুষ্টিমেয় একককে কেস হিসেবে বাছাই করা হয়। এ পদ্ধতিতে দুই একটি ঘটনা বলির মাধ্যমে সমগ্র ঘটনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অন্যান্য পদ্ধতিতে ব্যাপক সংখ্যক একককে অধ্যয়ন করা হয়। কেস স্টাডি পদ্ধতির অধ্যয়ন রীতি এমন যাতে ব্যাপক সংখ্যক একক অধ্যয়ন করা সম্ভব নয়।
কোনো ঘটনা বিস্তৃত ও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে
এ পদ্ধতিতে অধ্যয়নের বিষয় খুব গভীর অর্থাৎ নির্বাচিত বিষয়কে গভীরভাবে অধ্যয়ন করা হয়। বিষয়বস্তুর হালকা পাতলা বা সাদামাটা গোছের বিশ্লেষণ কেস স্টাডি পদ্ধতিতে প্রায় অনুপস্থিত।
এ পদ্ধতিতে অধ্যয়নের বিষয় কেবল গভীরই নয় বরং বিস্তৃতও। এতে নির্বাচিত এককের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে সকল দিক নয় বরং নির্দিষ্ট দিকই এ পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে।
ঐতিহাসিক পদ্ধতির অনুসরণ করে
কেস স্টাডি পদ্ধতি বর্তমানকে জানার জন্য কোনো বিষয়ের উৎপত্তি ও বিকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এজন্য এ পদ্ধতি প্রায়ই ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। অর্থাৎ এ পদ্ধতি ঐতিহাসিক পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বর্তমানকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে থাকে।
কার্যকর সম্পর্ক বিশ্লেষণ ও সাধারণীকরণ করা যায়
কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ, সাধারণীকরণ ও তত্ত্ব যাচাই করার জন্যেও কেস স্টাডি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। ঐতিহাসিক ভাবে বলা যায়, কোনো সামাজিক এককের জীবন ধারা বিশ্লেষণের জন্যেই এ পদ্ধতির উৎপত্তি ঘটেছিল। তবে বর্তমানে এই পদ্ধতির সাহায্যে অনেক বিষয়ই ব্যাখ্যা করা হয়।
নির্বাচিত বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অধ্যয়ন করে
কেস স্টাডি পদ্ধতি নির্বাচিত একককে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অধ্যয়ন করে। তবে এই কথার অর্থ এই নয় যে, একজন মানুষকে শিশুকাল থেকে বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত অধ্যয়ন করতে হবে বরং একজন মানুষের জীবনের দীর্ঘ দিনের ঘটনাবলী জানতে হয়।
গুণগত পদ্ধতি
কেস স্টাডি পদ্ধতি একটি গুণগত বিশ্লেষণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয় সেগুলো সাধারণত গুণাত্মক পদ্ধতির হয়, সংখ্যাগত নয়।
সুনির্দিষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতি
কেস স্টাডি পদ্ধতি মূলত কোনো সমস্যা সমাধানের প্রায়োগিক পদ্ধতি। এটি কোন কল্পনাপ্রসূত পদ্ধতি নয় বরং এটি একটি সুনির্দিষ্ট এবং বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে তত্ত্বের ওপর তেমন কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
নমনীয় পদ্ধতি
কেস স্টাডি পদ্ধতি এক ধরনের নমনীয় প্রকৃতির অনুসন্ধান পদ্ধতি। এতে তথ্য সংগ্রহের জন্য যে কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে এবং এ পদ্ধতি যেকোনো সমস্যা সমাধানে অধিকতর কার্যকরী।
উদঘাটনমূলক এবং অনুসন্ধানমূলক পদ্ধতি
কেস স্টাডি পদ্ধতি অনানুষ্ঠানিক বিষয়াদি অধ্যয়নের পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে এমন অনেক ব্যক্তিগত ও অনানুষ্ঠানিক বিষয় অধ্যয়ন করা হয় যেগুলো অন্যান্য পদ্ধতিতে করা হয় না।
কেস স্টাডির ধাপসমূহ – Stages of Case Study
সাধারণত কেস স্টাডি পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি মৌলিক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এ প্রসঙ্গে George A Lundberg উল্লেখ করেছেন, কেস স্টাডি পদ্ধতি আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয় বরং বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার একটি প্রাথমিক ধাপ মাত্র।
তবে, আধুনিককালে এই পদ্ধতি বিভিন্ন জটিল সমস্যা সমাধানের বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় বলে এর সর্বক্ষেত্রে যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত মান বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। সে কারণে বর্তমানে কেস স্টাডি নির্দিষ্ট নকশা বা পরিকল্পনা ভিত্তিক হয়ে উঠেছে।
উপরন্তু এ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা এবং পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়াতে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা হয়। সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক কাজ করার ক্ষেত্রে কেস স্টাডি পদ্ধতি যে সকল ধাপ অনুসরণ করে তা নিম্নে আলোচনা করা হল:
প্রয়োজনীয় কেস নির্বাচন
প্রাথমিক কাজ শুরু হয় মূলত কোন সমস্যা চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে। তবে যেকোন বিষয়ে সমস্যা নির্বাচন করে নয়, বরং উপযুক্ত কেস নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। যা গবেষকের নির্দিষ্ট সমস্যা দৃষ্টান্ত হিসেবে অনুমিত। এসব প্রাসঙ্গিক দিক বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট সমস্যার গভীরতা ও বিস্তৃতি পরিমাপ করা হয়। সমস্যা বলতে এখানে মূলত এমন সমস্যাকে বোঝাবে যা সমাজের এক বা একাধিক শ্রেণীর উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, “অধিবাসীদের চিত্তবিনোদন সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক কোন সমাজ গবেষককে নির্দিষ্ট কোন একটি অধিবাসী শ্রেণী নির্বাচন করে তাদের সার্বিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করতে পারেন।” আবার , “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ফ্যাক্ট চেকিং প্রবণতাঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর একটি সমীক্ষা” এটিও একটি কেস।
সাময়িক অনুমান গঠন
কেস স্টাডিতে সঠিক তথ্যসংগ্রহের উদ্দেশ্যে এমন কিছু অনুমান গঠন করে কাজ করা হয়, যা সাময়িক সম্পর্ক এবং কেবল গবেষকের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে সহায়ক। কেননা, এ ধরনের অনুমানের পথ নির্দেশনা ছাড়া এক্ষেত্রে পক্ষপাত দুষ্ট ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্য অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় ।
উপযুক্ত তথ্য সংগ্রহের উৎস ও মাধ্যম নির্বাচন
কেস স্টাডিতে সাধারণত একাধিক সূত্র হতে বিভিন্ন উপকরণ বা মাধ্যম ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্যের উৎস প্রধানত দুটি। যথা:
- প্রত্যক্ষ উৎস- যেমনঃ এককের বক্তব্য, এককের অবস্থা, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি;
- পরোক্ষ উৎস- যেমনঃ ডকুমেন্ট, রেকর্ড, সাহিত্য, ব্যক্তিগত লেখা ইত্যাদি;
পাশাপাশি যেসব উপকরণ তথ্য সংগ্রহকল্পে ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার, পরীক্ষা ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম যেমন চেকলিস্ট, গাইড ইত্যাদি। কেস স্টাডির এ পর্যায়ে তথ্যের যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধির প্রয়োজনে উৎস ও উপকরণ নির্বাচন যথেষ্ট সতর্কতা ও দক্ষতার সাথে করা প্রয়োজন। তাছাড়া বিভিন্ন মূল্যবোধের প্রভাব মুক্ত হওয়া ও পক্ষপাতদুষ্টতা রোধের সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টাই এখানে করা বাঞ্ছনীয়।
তথ্য সংগ্রহ
কেস স্টাডির এ পর্যায়ে বিভিন্ন উৎস হতে একাধিক কৌশল ব্যবহার করে গ্রহণযোগ্য তথ্য ও সংগ্রহ করতে হয়। এসব তথ্য সংগ্রহের সময় গবেষক অথবা তার নিয়োজিত তথ্য সংগ্রহকারীদের কেস স্টাডির উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি এবং তথ্য সংগ্রহের কৌশলসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়। তাছাড়া সংগ্রহকালে কর্তব্য তত্ত্বাবধান ও ক্রস চেকিং এর ব্যবস্থা রাখতে হয়।
তথ্য বিশ্লেষণ
কেস স্টাডির এ পর্যায়ে মাঠ হতে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যাবলি বর্ণনাত্মক উপায়ে বিশ্লেষণ উপযোগী করে তোলা হয়। এরপর গবেষকের উদ্দেশ্য অনুযায়ী তথ্যগুলো বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো উপস্থাপন করা হয়।
সমাধান প্রদান ও ফলো-আপ
কেস স্টাডির এ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কেসের কি কি সমস্যা আছে এবং তা কিভাবে দূর করা যাবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাছাড়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রদত্ত সেবা কর্ম অনুসরণ বা Follow up এর দিকনির্দেশনাও এখানে থাকবে।
কেস স্টাডি পদ্ধতির সুবিধা – Advantages of Case Study
পদ্ধতিগত দিক থেকে এবং ব্যবহারিক উপযোগিতার দিক থেকে কেস স্টাডি পদ্ধতির অনেক সুবিধা রয়েছে। এ পদ্ধতির প্রধান কতিপয় সুবিধা নিম্নে আলোচনা করা হল :
নমনীয়তা
তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিগত দিক থেকে কেস স্টাডি একটি নমনীয় পদ্ধতি। এতে পর্যবেক্ষণ, প্রশ্নমালা, জরিপ, সাক্ষাৎকার, মৌখিক আলোচনা, দলিল, চিঠিপত্র, ডায়েরি ইত্যাদি পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। গবেষক গবেষণার প্রয়োজন অনুসারে যে কোনে, এহণযোগ্য পদ্ধতি অবলম্বন করতে পাবেন।
সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি
শুধু তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিগত দিক থেকেই নয় বরং অন্য মাত্রাগুলোতেও কেস স্টাডি পদ্ধতি নমনীয় প্রকৃতির। গবেষণার বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ও কেস স্টাডিতে অধ্যয়ন করা হয়। এর ফলে কোনো সমস্যাকে সামগ্রিকভাবে দেখা সম্ভব হয়।
বিষয়বস্তুর গভীরতা
সমস্যার পরিধিগত ব্যাপকতাই কেবল কেস স্টাডির অন্যতম বৈশিষ্ট্য নয় বরং বিষয়বস্তুর গভীরতাও এ পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ পদ্ধতিতে গবেষণার বিষয়কে গভীরভাবে অধ্যয়ন করা হয়। যেহেতু এক বা মুষ্টিমেয় কেন নিয়ে এ পদ্ধতিতে গবেষণা করা হয়, কাজেই এতে বিষয়বস্তুকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করার সুযোগ থাকে।
গ্রহণযোগ্যতা
গবেষণা এলাকা নির্ধারণে গবেষকদের প্রধান বিবেচ্য বিষয়গুলো হচ্ছে : বিশ্লেষণের এককের সহজপ্রাপ্যতা, গবেষণার ব্যয়, সময় ও জনশক্তি। এসব দিক থেকে কেস স্টাডি পদ্ধতি অধিকতর গ্রহণযোগ্য এবং যে কোনো সামাজিক অবস্থাতেই গবেষণা কার্য পরিচালনা করা সম্ভব।
ব্যয় কম
গবেষণার পরিধি ও তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি বিবেচনায় কেস স্টাডি পদ্ধতি কম ব্যয়বহুল। কেননা, এ পদ্ধতিতে এক বা মুষ্টিমেয় কেসকে অধ্যয়ন করা হয় এবং তথ্য সংগ্রহের যে কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। গবেষণার ব্যয়ের দিক বিবেচনায় এ পদ্ধতিটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি।
নমুনাজনিত ভ্রান্তি নেই
কেস স্টাডি পদ্ধতিতে নমুনার প্রয়োজন হয় না। কাজেই এ পদ্ধতিতে নমুনায়নের ভ্রান্তি জনিত সমস্যার সম্ভাবনা নেই এবং নমুনায়নের বাড়তি সমস্যাও এতে নেই।
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা
কেস স্টাডি পদ্ধতিতে কোনো সমস্যার পটভূমি, ইতিহাস ও বিকাশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। ফলে সমস্যার বর্তমান অবস্থাকে সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব। বিশেষ করে যেসব সমস্যার বীজ অতীতে নিহিত সেই সব সমস্যা অধ্যয়নে এ পদ্ধতি খুবই কার্যকর।
জটিল সমস্যা উপলব্ধি
উন্নয়নশীল সমাজের জটিল সমস্যা উপলব্ধি করতে কেস স্টাডি পদ্ধতি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা, এসব সমাজের দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল সমস্যাগুলোকে ঐতিহাসিক ও সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে কার্যকর সমাধানের পথ উদঘাটন করা সম্ভব। আর এ কাজটি কেস স্টাডি পদ্ধতি সহজেই করতে পারে।
তত্ত্ব যাচাই
কেস স্টাডি পদ্ধতি তত্ত্ব যাচাই করতে সহায়তা করে। এ পদ্ধতি জরিপ পদ্ধতির মতোই তথ্য সংগ্রহ করে এবং সংগৃহীত তথ্যের সাহায্যে তত্ত্বের বৈধতা পরীক্ষা করে। অনুরূপভাবে সাধারণীকরণের ব্যাপারেও এ পদ্ধতি জরিপ পদ্ধতির মতই কার্যকর।
অনানুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা
কেস স্টাডি পদ্ধতি অধ্যয়নের কেস গুলোর অনেক ব্যক্তিগত বিষয়াদির অধ্যয়ন করে। এর ফলে অনেক অনানুষ্ঠানিক বিষয় উদ্ঘাটিত হয় যেগুলো জরিপ পদ্ধতি বা অন্য কোনো আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে অর্জন করা সম্ভব নয়।
উত্তম অনুমান গঠন
উত্তম ও নির্ভরযোগ্য অনুমান গঠনে কেস স্টাডি পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, এ পদ্ধতিতে কেসকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করা হয় এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োগ করে উপসংহার টানা হয় যা বৈধ ও উত্তম অনুমান গঠনে ভীষণ ভাবে সহায়তা করে।
কেস স্টাডি পদ্ধতির অসুবিধা – Disadvantages of Case Study
কেস স্টাডি পদ্ধতির কতিপয় সুবিধা থাকলেও এ পদ্ধতির অসুবিধা অনেক। এর ফলে সীমিত কিছু ক্ষেত্রেই এ পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষণীয়। কেস স্টাডি পদ্ধতির প্রধান প্রধান অসুবিধা নিম্নে তুলে ধরা হল:
সাধারণীকরণের সমস্যা
কেস স্টাডি পদ্ধতিতে খুব সীমিত আকারেই সাধারণীকরণ করা সম্ভব। কেননা একটি বা সামান্য কয়েকটি কেন অধ্যয়ন করে সাধারণীকরণ করা সঠিক হয় না বরং এজন্য প্রয়োজন অনেক কেস অধ্যয়ন করা। উপর, গবেষণার জন্য নির্ধারিত কেস প্রতিনিধিত্বমূলক নাও হতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে সাধারণীকরণ ভ্রান্ত হতে বাধ্য।
অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
অনেকে কেস স্টাডি পদ্ধতিকে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে অভিহিত করেছেন। কেননা, এ পদ্ধতির বিভিন্ন পর্যায়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ও সংগঠিত পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় না। এর ফলে প্রাপ্ত তথ্যের উপরও নির্ভর করা যায় না।
আংশিক পদ্ধতি
কেস স্টাডি পদ্ধতিকে অনেকে আংশিক পদ্ধতি হিসেবে মনে করেন। এ পদ্ধতি এককভাবে কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না বরং কোন পদ্ধতির সহযোগী পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
সর্বজনীন নয়
কেবল দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই কেস স্টাডি পদ্ধতিতে গবেষণা কার্য পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু দক্ষ ও অভিজ্ঞ গবেষকদের অভাব সব সমাজেই বিদ্যমান। এ পদ্ধতি তরুণ গবেষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা
এ পদ্ধতিতে গবেষকের পক্ষপাতিত্বের সুযোগ রয়েছে। তথ্য সংগ্রহে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের অভাবে এবং গবেষকদের ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার ফলে গবেষকের মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণা দ্বারা গবেষণাকর্ম সহজেই প্রভাবিত হতে পারে।
গুণাত্মক তথ্য
কেস স্টাডি পদ্ধতিতে সংগৃহীত তথ্য প্রধানত গুণাত্মক। এসব তথ্যকে সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় না। অথচ বর্তমানকালে সামাজিক অধ্যয়নে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বহুল প্রচলিত ও সুফলদায়ক।
অপ্রামাণ্য তথ্য
অনেক সময়ই প্রামাণ্য দলিল বা ডকুমেন্ট পাওয়া যায় না বরং অপ্রামাণ্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। ফলে কেস স্টাডির মাধ্যমে গবেষণার বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত ফলাফল পাওয়া যায় না।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সামাজিক গবেষণার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো কেস স্টাডি পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো নির্দিষ্ট সমস্যার স্বরূপ উন্মোচন করে তার সুষ্ঠু সমাধানকল্পে সম্যক সহায়তা করা।
কেস স্টাডি পদ্ধতি সমাজকর্ম, সমাজবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, মনোচিকিৎসা, অর্থনীতি শিক্ষা ইত্যাদি বহুক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফলে সামাজিক গবেষণায় কেস স্টাডি পদ্ধতি হয়ে উঠেছে গবেষকদের কাছে এক জনপ্রিয় পদ্ধতি।
তথ্যসূত্র - References
- 1গ্রন্থ: Research Methodology and Fieldwork; সংস্করণ: ; লেখক: Pauline V. Young; প্রকাশক: e-PG Pathshala INFLIBNET Centre; প্রকাশকাল: 1966; উদ্ধৃতি: “Case study is a comprehensive study of a social unit, be it a person, a group of persons, an institution, a community or a family.”
- 2গ্রন্থ: Methods in Social Research; সংস্করণ: ; লেখক: William Josiah Goode, Paul K. Hatt; প্রকাশক: Mcgraw-Hil; প্রকাশকাল: 1981; উদ্ধৃতি:
- 3গ্রন্থ: Theory and Practice in Social Research; সংস্করণ: ৩য় (পরিমার্জিত); লেখক: Dr. Hans Raj; প্রকাশক: Surjeet Publications; প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০১৮; উদ্ধৃতি: “The method of exploring and analysing the life of a social unit be that a person, a family or an institution, or a community be called case study.”